ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

রেললাইন সংস্কারের অভাবে ১৩ বছর ধরে বন্ধ মধ্যপাড়া খনির পাথর পরিবহন ॥ ৪২৭ কোটির টাকার পাথর অবিক্রিত

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর

প্রকাশিত: ১৭:০১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৭:০৩, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

রেললাইন সংস্কারের অভাবে ১৩ বছর ধরে বন্ধ মধ্যপাড়া খনির পাথর পরিবহন ॥ ৪২৭ কোটির টাকার পাথর অবিক্রিত

রেললাইন সংস্কারের অভাবে ১৩ বছর ধরে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের মধ্যপাড়া পাথর খনি রেলপথে পাথর পরিবহনের কাজ বন্ধ রয়েছে। সড়কপথে পরিবহন খরচ বেশি হওযায় এর প্রভাব পড়ছে পাথরের দামে। রেলপথের তুলনায় সড়কপথে পাঁচগুণ টাকা খরচ হয়ে থাকে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এই খনির পাথর রেলপথে পরিবহন করার কথা থাকলেও, বাধ্য হয়ে পাঁচ গুণ খরচে মধ্যপাড়া খনির উৎপাদিত পাথর ১৩ বছর ধরে পরিবহন করা হচ্ছে সড়ক পথে।
পেট্রোবাংলার অধীন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খনির উৎপাদিত ৮০ ভাগ পাথর রেলপথে পরিবহন করতে হবে। কিন্তু ওই নির্দেশনা গত ১৩ বছর ধরে কোন কাজে আসছে না। খনি সূত্রে জানা যায়, গড়ে প্রতিদিন উৎপাদিত পাথরের পরিমান হলো প্রায় পাঁচ হাজার মে.টন। প্রতিদিন পাথর বিক্রি হয় প্রায় আড়াই হাজার টন। সব মিলিয়ে উত্তোলিত পাথরের অর্ধেক থেকে এক-তৃতীয়াংশই অবিক্রীত রয়েছে। বতর্মানে নদী শাসনের জন্য ৮৬ কোটি টাকার বোল্ডার ২ লাখ ৭০ হাজার মে. টন পাথর এবং রেলপথের জন্য ২২৭ কোটি টাকার ব্লাস্ট ৬ লাখ ২৪ হাজার মে. টন পাথর ছাড়াও আরও ১১৪ কোটির টাকার পাথর মজুত রয়েছে। বর্তমানে মধ্যপাড়ায় খনির ১২ ইয়ার্ডে সব মিলিয়ে ৪শ’ ২৭ কোটির টাকার পাথর অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে।
১৯৯০ সালে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলে রেলপথে পাথর পরিবহন। কারণ ২০১১ সালে পার্বতীপুরের ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার রেলপথের বেশ কয়েকটি জায়গার ৭০টি স্লিপার (পাটাতন) চুরি যায়। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ওই পথে পাথরবাহী ওয়াগনের চলাচল। অকেজো হয়ে পড়ে ‘পাথর পরিমাপ স্কেল’। এ রেলপথে অবকাঠামো ও রেললাইন সংলগ্ন জমি স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। পরিত্যক্ত থাকায় এই রেলভূমির ওপর উদ্বাস্তুদের বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে। উজাড় হয়েছে রেলভূমির গাছপালা। চুরি হয়েছে এ রেলপথের প্রায় ৫ কিলোমিটার রেললাইন।
রেলপথ চালুর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী  মো: ফজলুর রহমান বলেন, রেলপথে পাথর পরিবহনে ভৈরব-ঢাকা পর্যন্ত প্রতি টনে খরচ হয় মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা। অথচ সমপরিমাণ পাথর সড়কপথে পরিবহনে প্রতিটনে খরচ হয় ১ হাজার ৪শ' টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এতে পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হচ্ছে। পাথর পরিবহন খাতে ব্যাপক আর্থিক অপচয় হয়েছে। তিনি জানান, দেশে পাথরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২ কোটি ১৬ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমান মজুত থাকার পরও, এ চাহিদার সিংহভাগ আমদানি করা হয় ভারত ও ভুটান থেকে। এতে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। সেই সাথে দেশের মেগা প্রকল্পসহ অনেক নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় মধ্যপাড়া খনির পাথর বিক্রি কমেছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ও নদী শাসন এবং দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় বিশ্বের উন্নতমানের পাথর হিসেবে স্বীকৃত মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ রেলপথে তা পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায়, বড় অঙ্কের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।

 

 

 

জানা গেছে, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড খনিটি পরপর চারবার লাভের মুখ দেখেছে। বর্তমানে খনিটিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশি প্রকৌশলী এবং প্রায় ১ হাজার দক্ষ খনি শ্রমিক কাজ করছেন। যারা প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করছেন। ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া পাথর খনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার বিষয়ে জানতে চাইলে, রেলওয়ের পূর্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী রাজা আলী শেখ বলেন, ভবানীপুর-মধ্যপাড়া রেলপথে বর্তমানে স্লিপার, ফিটিংস, পাথর কিছুই নেই। ওই পথের রেললাইন চুরি গেছে। এ অবস্থায় ওই রেলপথে পাথর পরিবহন অসম্ভব। রেল যোগাযোগ চালু করতে হলে নতুন করে পাথরের কংক্রিট, নতুন রেললাইন স্থাপন ও দু'ধারে মাঠির কাজ করতে হবে।
ভবানীপুর রেলস্টেশন-মধ্যপাড়া রেলপথ সংস্কারে পদক্ষেপের বিষয়ে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী আসাদুর হক বলেন, প্রায় ২৫ কোটি ব্যয়ে ভবানীপুর থেকে মধ্যপাড়া পাথরখনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী জানুয়ারী মাসে এই রেলপথের কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে খনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
এদিকে,পাথর বিক্রি কমে যাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়েছে খনি কর্তৃপক্ষ। ধার-দেনা করে ঠিকাদারের বিল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। দ্রুত এসব পাথর বিক্রিতে গতি বাড়াতে না পারলে, জায়গার অভাবে কিছু দিনের মধ্যে খনির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে খনির কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমান বিস্ফোরক-এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে কয়েক শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। খনিটি বন্ধ হয়ে গেলে জিটিসির অধীনে খনিতে কর্মরত প্রায় ১ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মহীন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি খনি কর্তৃপক্ষের লোকসানের পাল্লা ভারী হবে এবং খনি রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসিকেও মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

মোহাম্মদ আলী

×