ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প

নিজস্ব সংবাদদাতা, শরীয়তপুর 

প্রকাশিত: ০০:০৪, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প

সময়ের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে শরীয়তপুরের ২শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প। প্লাস্টিক, মেলামাইন, লোহা ও স্টিলের তৈরি জিনিসপত্রের সহজলভ্যতা ও দামে কম হওয়ায় কাঁসা-পিতল শিল্প বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। প্রাচীনকাল থেকে শরীয়তপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পের সুখ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। 

এক সময় দিনরাত ব্যস্ত থাকতো শরীয়তপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পীরা। ভোরে হাতুড়ির টুংটাং শব্দে ঘুম ভাঙ্গতো এলাকাবাসীর। তবে দিন দিন এই শিল্পের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, কারিগরের অভাব, ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে যাওয়া এবং প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে ধ্বংসের পথে শিল্পটি। দ্রুত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এ শিল্প অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে বলে এ শিল্পের মালিক ও কারিগররা জানিয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এ শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। 

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, শরীয়তপুর সদর উপজেলার দাসার্ত্তা, বিলাসখান, কোটাপাড়া, নরবালাখানা ও বাঘিয়া গ্রামে প্রায় ৩শতাধিক কাঁসা-পিতলের কারখানা ছিল। প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত ছিল। পাতিল, বালতি, কলস, ঘটি, বাটি, ডাবর, পানদান, পুস্পপত্র, ধুপদানী, প্রদীপ, নৌকাসহ কাঁসা-পিতলের নানা আকর্ষণীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হত। এসব পণ্য ঢাকাসহ দেশের বাইরেও রপ্তানী করা হতো। দিন-রাত কারিগরদের হাতুড়ের টুং টাং শব্দে মুখরিত থাকতো পুরো এলাকা। 

কাঁসা-পিতল কারখানার মালিক দাসার্ত্তা গ্রামের কাজী সিরাজ বলেন, শুধু দাসার্ত্তা গ্রামে এ কারখানা আছে হাতে গোণা ৮/৯টি। জড়িত আছে মাত্র ৫০টি পরিবার। কাঁচা মালের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট ও গ্রাহক চাহিদা কমে যাওয়ায় থমকে গেছে এ শিল্প। এ শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও শিল্পীরা রয়েছে নানা অভাব অনটনে। 

তাছাড়া প্লাস্টিক, মেলামাইন ও স্টিলের তৈরি জিনিসপত্রের সহজলভ্যতা ও দাম কম হাওয়া ক্রেতারা সেদিকে ঝুঁকে পড়ায় বিলুপ্তির পথে কাঁসা-পিতল শিল্প। দাসার্ত্তা গ্রামের সেন্টু চৌকিদার, কারিগর থেকে এখন কারখানার মালিক হয়েছেন। তিনি বলেন, নানা কারণে কাঁসা-পিতল শিল্পীদের অনেকেই চলে গেছেন ভারতে। অনেকেই করেছেন পূর্ব পুরুষদের পেশা পরিবর্তন। বর্তমানে দাসার্ত্তা গ্রামের কাজী সিরাজ, ইদ্রিস চৌকিদার, সেন্টু চৌকিদার, নুরুল হক ও মোক্তার কাজী গংরা এ শিল্পটিকে কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছেন। 

কাঁসা-পিতল শিল্পের দৈন্যদশা সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্টু চৌকিদার ও কাজী সিরাজ বলেন, আগের মতো কেউ কাঁসা পিতলের জিনিস কিনতে চায় না। বাজারে এখন অল্প দামে মেলামাইন ও প্লাস্টিকসহ নানা ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। লোকজন তাই বেশি দাম দিয়ে কাঁসা-পিতলের জিনিস কেনে না। এতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তারা। 

শরীয়তপুর জেলা শহরের পালং বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কাঁসা-পিতলের তৈরি নানা জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন রনজিৎ কংস বণিক। 

তিনি জানান, দোকানে নেই কোন বেঁচা-বিক্রি। লোকসান গুণেও ২শ’ বছরের পৈত্রিক এ পেশা ধরে রেখেছেন তিনি। পূর্বে পালং বাজারে কাঁসা-পিতল তৈজসপত্রের অর্ধশত দোকান থাকলেও এখন আছে মাত্র ২টি। 

কারখানা মালিক ও পালং বাজারের ব্যবসায়ী রনজিৎ কংস বণিক আরো বলেন, বছরের পর বছর লোকসান গুণেও পৈত্রিক পেশা বিলুপ্ত হতে দিতে চান না তিনি। তাইতো কোন ক্রেতা না থাকলেও লোকসান গুণে দোকান পেতে বসে থাকেন। 

ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রূপকর্ম ঠিক করার দাবি জানান তিনি। 

এসআর

×