এসপি বাবুল আক্তার
চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় প্রায় তিন বছর সাত মাস পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে পুলিশ পাহারায় একটি প্রাইভেট কারে চড়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এ সময় তার সঙ্গে দ্বিতীয় স্ত্রী ইসরাত জাহান মুক্তাসহ পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। তবে তিনি কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি।
বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দীন চৌধুরী কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের জানান, উচ্চ আদালত জামিনের আদেশ দিয়েছে, জজ আদালত রিলিজ অর্ডার দিয়েছে। আদেশের কপি কারাগারে পাঠানোর পর তিনি মুক্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, অস্বাভাবিকভাবে তাকে স্ত্রী হত্যার মামলায় জড়ানো হয়েছে। কাল্পনিক একটা কাহিনী দিয়েই তাকে ফাঁসানো হয়েছিল, বাধ্য করা হয়েছিল পুলিশের চাকরি ছাড়তে।
এদিকে বাবুল আক্তার জামিনে মুক্ত হওয়ার খবরে জেলগেটে ভিড় করেন গণমাধ্যম কর্মীসহ উৎসুক মানুষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা। এর পাশাপাশি বাবুল আক্তারকে বহনকারী প্রাইভেটকারটির আগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি টিমও ছিল কারাগার থেকে বের হওয়ার সময়। তিনি গাড়ি থেকে নামেননি। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে এর আগে বাবুল আক্তারের আইনজীবী কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। সেখানে উঠে আসে বিভিন্ন বিষয়।
বাবুল আক্তারের আইনজীবী স্পষ্ট করে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। তার স্ত্রী খুন হয়েছেন, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাবুল আক্তারকে মামলায় আসামি করার বিষয়টি অস্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালের ১০ মে তাকে আটক করা হয়। তাকে বলা হয়েছিল- মামলার চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে, যাতে তিনি এসে দেখেন। এভাবেই বাবুল আক্তারকে সেখানে আটক রাখা হয়েছিল বেআইনিভাবে। তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল ১২ মে। আর আটক রাখা হয়েছিল ১০ মে থেকে। এ মামলার পিবিআইয়ে যাওয়াটা ছিল অস্বাভাবিক বিষয়। স্ত্রী হত্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাবুল আক্তার, তার ছেলে-মেয়ে এবং পরিবার।
তদন্তের সময় মিতুর যে মোবাইলের সিম, তা একজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। অবাক বিষয়, ওই ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রহস্যজনকভাবে তাকে আসামি বা সাক্ষী করা হয়েছে। যে হোন্ডা ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছিল মিতুকে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কিন্তু পরে আসামি বা সাক্ষী করা হয়নি।
প্রকৃত আসামিদের সবসময় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল জানিয়ে সিনিয়র এ আইনজীবী বলেন, সবসময় লক্ষ্য ছিল বাবুল আক্তারকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করা। অস্বাভাবিকভাবে তাকে জড়ানো হয়েছে এ মামলায়। এ মামলায় অনেক কাহিনী আছে। বাবুল আক্তারের মামলায় যে ফাইনাল রিপোর্ট দিল, তা অস্বাভাবিক। ১০ মে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে সন্ধ্যায়। সেদিনই হেড কোয়ার্টার থেকে অ্যাপ্রুভ হয়ে গেল। অথচ রাতে অফিস বন্ধ। পরদিন দেখা গেল আরেকটি মামলা চালু হয়ে গেল। বাবুলের শ্বশুর মামলা ফাইল করল পাঁচলাইশ থানায়, ওসি তদন্তভার নিল। ভার নেওয়ার মুহূর্তের মধ্যে মামলা চলে গেল পিবিআইতে। সমস্ত কর্মকা- ছিল অস্বাভাবিক।
তাকে মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে কথিত এক গায়েত্রীর নামে। আমি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে দেখেছি- সেই গায়েত্রী তার চেয়ে ১০ বছরের বড়। সে কালো। তামিলনাড়–র এক মহিলা। তার মুভমেন্ট রেজিস্টার দেখেছি- সে পৃথিবীর কোথাও ১৫ থেকে ২০ দিনের বেশি থাকে না। খুব ব্যস্ত। সে নেদারল্যা-ের নাগরিক এখন। তাকে সাক্ষী করল না, তার বক্তব্য নিল না। কাল্পনিক একটি কাহিনী দিয়ে বাবুলকে ফাঁসানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যারা প্রকৃত খুনি, খুনের কাজে জড়িত ছিল তাদের কেন ছেড়ে দিল, এর রহস্য উদ্ঘাটন করে বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার পেছনের যারা প্রকৃত কারিগর, তাদের চিহ্নিত করা দরকার ছিল। চাকরি পুনর্বহাল বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাবুল আক্তারের আইনজীবী বলেন, চাকরিতে পুনর্বহাল তো হবেই। তাকে জোর করে রেজিগনেশন নিয়েছিল। বাবুল আক্তারকে বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি চাকরি ছাড়ো, না হয় তোমাকে শেষ করে দেব।’ সে বাধ্য হয়ে, চাপে পড়ে করেছে। যদিও ওই সময় তার শ্বশুরপক্ষ থেকে এবং তার পক্ষ থেকে প্রটেস্ট করা হয়েছিল। তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেনকে বিভিন্ন কারণে তার বিপক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এসব কথা জনসম্মুখে নাই বলি।
অপরদিকে ঢাকায় উচ্চ আদালতে বাবুল আক্তারের জামিন আদেশের পর তার সাবেক শ্বশুর মোশাররফ হোসেন জামিনের স্থগিতাদেশ চেয়ে যে আবেদন করেছিলেন তা চেম্বার জজ আদালত খারিজ করে দেন। ফলে বাবুল আক্তারের মুক্তি পেতে আর বাধা নেই বলে দুপুরে জানিয়েছিলেন আইনজীবী শিশির মনির। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাবুল আক্তারের মুক্তিতে বাধা নেই। বুধবার তিনি মুক্তি পাবেন। জামিননামা ইতোমধ্যে দাখিল করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চাঞ্চল্যকর এ মামলায় এ পর্যন্ত ৫২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ১৪ আগস্ট মিতু হত্যা মামলায় চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বাবুল আক্তারের জামিন আবেদন করা হয়েছিল। ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে ১৮ আগস্ট জামিন আবেদন নাকচ করে আদালত। মিতু হত্যা মামলাটি বর্তমানে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিনের আদালতে বিচারাধীন। এই মামলায় মোট সাক্ষী ৯৭ জন। ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্যের মধ্যে দিয়ে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মা শাহেদা মোশাররফসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বাবুল আক্তার ওই ঘটনার কিছুদিন আগেই চট্টগ্রাম থেকে বদলি হন। তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে এ হত্যাকা- ঘটে। ঘটনার পর টানা সাড়ে তিন বছর তদন্ত করেও গোয়েন্দা পুলিশ কোনো অগ্রগতি করতে না পারায় ২০২০ সালের জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই। এরপর ২০২১ সালের মে মাসে পিবিআই জানায়, স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল বাবুল আক্তারের ‘পরিকল্পনায়’। আর এজন্য খুনিদের ‘লোক মারফত তিন লাখ টাকাও দিয়েছিলেন’ বাবুল।
পরে বাবুলের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আবার মিতুর বাবা আরেকটি মামলা করেন। তবে মিতুর বাবার করা সেই মামলা আদালতে না টেকায় বাবুলের মামলাটিই আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সেই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। তাতে বাবুলসহ ৭ জনকে আসামি করা হয়। এরপর ওই বছরের ১০ অক্টোবর সেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত।