ডিসেম্বরের প্রথমভাগে মুক্ত হওয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল যশোর
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তবে তারও আগে শত্রুমুক্ত হয়েছিল বেশ কিছু অঞ্চল। মার্চে শুরু হওয়া যুদ্ধ ডিসেম্বরে এসে তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিলে আক্রমণ আরও জোরদার হয়। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পিছু হটতে থাকে বর্বর পাকিস্তানিরা। যৌথ বাহিনী ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে ঢাকার দিকে। ঢাকা অভিযানের অংশ হিসেবেই একের পর এক অঞ্চল মুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস এবং অন্যান্য নথি অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর আসে বড় সাফল্য। এদিন অনেকগুলো এলাকার মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকাটিতে ভয়ংকর গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এখনো গণহত্যার সাক্ষ্য বহন করছে বাগবাড়ির গণকবর। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই জেলায় ২৯টি অভিযান পরিচালনা করেন। এগুলোর মধ্যে ১৯টিই ছিল সম্মুখ সমর।
যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ছিল কাজির দিঘীর পাড়, মিরগঞ্জ, চৌধুরী বাজার, দালাল বাজার, রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসা, বাসু বাজার, ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, চর আলেকজান্ডার, প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রামগঞ্জ হাই স্কুল এবং রামগঞ্জের গোডাউন এলাকা। বীর মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের শুরুতেই মাদাম ব্রিজ ধ্বংস করে দেন। এর পর একের পর এক অভিযানে নাস্তানাবুদ হতে থাকে পাকিস্তানিরা। ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আস্তানাগুলোতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান চালান।
৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তারা। দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে এখানে শহীদ হন ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। লক্ষ্মীপুরে শহীদ হওয়া বীরদের মধ্যে ছিলেন শহীদ হন সৈয়দ আবদুল হালিম বাসু, আবু ছায়েম, রবীন্দ্র কুমার সাহা, মাজহারুল মনির সবুজ, মুনছুর আহম্মদ, মো. মোস্তফা মিয়া, জয়নাল আবেদিন চাঁদ মিয়া প্রমুখ।
একই দিন ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ২ নম্বর সেক্টরে অধীন কুমিল্লার দেবীদ্বার। আগের দিন ৩ ডিসেম্বর ভারতের ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর ডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় অভিযান চালানো হয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাঙ্কবহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। এই খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা রাতেই কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়।
৬ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী শত্রুমুক্ত হয় এদিন। ৩ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী ফুলবাড়ীর বেতদিঘী, কাজিয়াল, এলুয়াড়ী, জলপাইতলী, পানিকাটা, রুদ্রানী, আমড়া ও রানীনগর এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। এ অবস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানিরা ছোট যমুনা নদীর ওপর লোহার সেতুর পূর্ব অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরের অধীন দর্শনাও মুক্ত হয় ৪ ডিসেম্বর। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে আক্রমণ শুরু করে। চার ঘণ্টার লড়াইয়ে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার ঘাঁটি ল-ভ- হয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তানিরা পালিয়ে গেলে ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় দর্শনা। একইভাবে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী চুয়াডাঙ্গার জীবননগর মুক্ত করে। ১১ নম্বর সেক্টরে জামালপুরের বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর মুক্ত হয় ৪ ডিসেম্বর। কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটির প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এর আগে ৩ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয় পাকিস্তানিদের কাছে। বকশীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ এই চিঠি নিয়ে যান। চিঠি পেয়ে ক্যাম্পের অধিনায়ক আহসান মালিক প্রথমে চটে যান বটে। কিন্তু শেষতক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবিসহ ১৬২ জন সেনার একটি দল ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পিছু হটে শালচূড়া ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারাও। আহমদনগর হেডকোয়ার্টারের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ৩ ডিসেম্বর রাতেই ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে চলে যায় তারা। ফলে বিনা যুদ্ধে শত্রুমুক্ত হয় ঝিনাইগাতী। ৪ ডিসেম্বর সকালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে লাল সবুজের পতাকা ওড়ান।
দুদিন পর ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ফেনী। এদিন সকাল থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে থাকেন। নেতৃত্বে ছিলেন ২নং সাব সেক্টর কমান্ডার ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা লে. কর্নেল জাফর ইমাম। লাল সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে ফেনী শহরে প্রবেশ করেন তাঁরা। ৬ ডিসেম্বর সকালের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’য় লিখেছেন: বিজয়ের বেশে আমরা যখন ফেনী প্রবেশ করলাম। ক্ষণিকের মধ্যে ফেনী শহরে জনতার ঢল এসেছিল। শুরু হয় বিজয় মিছিল।
জয় বাংলা সেøাগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। রাস্তায় জনগণ যেখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে সেখানেই তাৎক্ষণিক তারা আলিঙ্গন করে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। রাস্তার দুপাশ থেকে জনতা দু’হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। মিছিলে মিছিলে শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশের পতাকা। অনেককে বিজয়ের আনন্দে কাঁদতে দেখেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয়েছিল যশোরও। ১৯৭১ সালের এইদিনে মুক্তিসেনাদের সহায়তায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে যায়। তবে তার আগেই পালিয়ে যায় পাকসেনারা। বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপ-প্রধান রবিউল আলমের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, জুলাই মাস থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচ- আক্রমণ চালাতে থাকে। শেষ অভিযান শুরু হয় ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পাক বাহিনী খুলনার দিকে পালিয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর মুক্তি বাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করে। মুক্ত শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা।
সিলেটের হবিগঞ্জ মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। আগের দিনের আক্রমণে শায়েস্তানগর ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। ৬ ডিসেম্বরে শীতের সকালে শহরবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানায়। মুক্ত হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি প্রথমে প্রবেশ করে সেটির নেতৃত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স নায়েক আব্দুস শহীদ। একইদিন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট ও নবীগঞ্জ উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। লালমনিরহাট এবং মেহেরপুরও মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর।
একদিন পর ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মাগুরা। ৬ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী নিজনান্দুয়ালী গ্রামসহ পাকিস্তানি ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ চালায়। এ অবস্থায় ভীত হয়ে পাকিস্তানিরা মাগুরা শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ৭ ডিসেম্বর মাগুরা শত্রুমুক্ত হয়। একই দিন স্বাধীনতার স্বাদ পায় নোয়াখালীর মানুষ। বগুড়াও মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পাক সেনারা তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে বগুড়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ঝালকাঠি, কুমিল্লা, চাঁদপুর। ৯ ডিসেম্বর মুক্ত হয় পাবনা, দাউদকান্দি। নড়াইল মুক্ত হয় ১০ ডিসেম্বর। একই দিন মুক্ত হয় ভোলা। ১১ ডিসেম্বর মুক্ত হয় লাকসাম।
এভাবে একটির পর একটি অঞ্চল মুক্ত করে যৌথবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পরিশেষে ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে জালিম পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান নিয়াজী।