বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে রেনেসা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মালিক বাবা-ছেলেকে খুজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পেড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। টাকা ফেরত পেতে বিনিয়োগকারীরা আইনগত সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে। মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশও করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকরা। উপজেলা প্রশাসন বলছে, অনিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে খোজ খবর নিয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
জানাযায়, বাগেরহাট সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের হালিশহর গ্রামের আনন্দ মোহন বিশ্বাস ২৪ বছর আগে স্থানীয় কৃষকদেরকে ঋণ দেওয়ার জন্য রেনেসা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ঋণ প্রদানের পাশাপাশি বাবা ধর্মগুরু প্রায়ত বিজয় গোশাইয়ের সুনাম কাজে লাগিয়ে নিজ গ্রাম ও পাশ্ববর্তী উপজেলা চিতলমারীর কৃষকদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকায় মাসে ১২০০ টাকা সুদ প্রদানের শর্তে বিনিয়োগ গ্রহন করতে থাকেন। কিছুদিন পর নিজেকে নির্বাহী পরিচালক এবং ছেলে প্রবির বিশ্বাসকে পরিচালক করে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিও‘র মত স্থানীয়দের কাছ থেকে বিপুল পরিমান বিনিয়োগ গ্রহন করেন। চিতলমারী উপজেলার দূর্গাপূরসহ বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি অফিস এবং বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য বেতনভুক্ত মাঠকর্মী নিয়োগ করেন আনন্দ মোহন বিশ্বাস।
মাঠকর্মীরাও নানা প্রলোভন দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমান বিনিয়োগ গ্রহন করতে থাকেন।বিপুল পরিমান বিনিয়োগ গ্রহন করলেও এই প্রতিষ্ঠানের কোন সরকারি অনুমোদন নাই। শুধুমাত্র সার কীটনাশক বিক্রি করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেডলাইসেন্স গ্রহন করেছিলেন তারা।
বিজয় গোশাইয়ের ছেলে হওয়ায় স্থানীয়রাও সরল বিশ্বাসে নিজেদের জমানো টাকা ব্যাংকে না রেখে রেনেসা এন্টারপ্রাইজে রাখেন। কিন্তু প্রায় ১০ মাস ধরে ধরে প্রতিষ্ঠানের অফিস তালা দেওয়া, পালিয়েছেন বাবা-ছেলে ও মাঠকর্মীরা। হালিশহর গ্রামে বাড়িতে গিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না রেনেসার মালিকদের। কষ্টের টাকা হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। আনন্দ মোহন বিশ্বাস ও তার ছেলে প্রবির বিশ্বাস তারককে আটক করে প্রতারণার শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি টাকা ফেরত চান গ্রাহকরা।
ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহক চিতলমারী উপজেলার খড়মখালি এলাকার বাসিন্দা উত্তম হালদার বলেন, ২০২১ সালে রেনেসা এন্টারপ্রাইজে প্রতিমাসে ১২শ টাকা লাভের শর্তে এক লক্ষ টাকা এককালীন জমা রেখেছিলাম। ১৪ মাস লাভের টাকা দিয়েছে। দুই বছর ধরে কোন টাকা দেয় না, তাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকায় যে অফিস ছিল তা সব বন্ধ।
সাবোখালী গ্রামের মলিনা বাড়ৈ নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, দুই ধাপে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা রেখেছিলাম, এখন লাভও দেয়না, মূল টাকাও পাইনা।
ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহক চিতলমারী উপজেলা সদরের মুদিব্যবসায়ী বিকাশ বালা বলেন, আনন্দ মোহন বিশ্বাসের বাবা বিজয় বিশ্বাস এই অঞ্চলের একজন সনাতন ধর্মীর গুরু ছিলেন। তার অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন।বিজয় বিশ্বাসের ছেলে হওয়ায় সরল বিশ্বাসে প্রতি লাখে মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা লাভের শর্তে ১০ লাখ টাকা এককালীন রেখেছিলাম। আমাকে আর্থিকভাবে শেষ করে দিয়েছে তারা। আমি এই প্রতারকদের শাস্তি চাই।
বিকাশ বালা বলেন, আনন্দ মোহন বিশ্বাস ও তার ছেলে প্রবীর বিশ্বাস ওরফে তারক চিতলমারী উপজেলার অন্তত কয়েক হাজার মানুষের একশ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। আমরা গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, মাইকিং ও সভা-সমাবেশ করেছি। তবুও টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
ভূক্তভোগী কাননচক গ্রামের হাসি রায় বলেন, ‘আমি বিধবা নারী।
৬ বছরে ডাবল দেওয়া স্কিমে ২ লাখ টাকা, মেয়ে দিপা রায়ের নামে ৮ হাজার ৫০০ টাকা ও ছেলে সুজন রায়ের নামে ৮ হাজার ৫০০ টাকা জমা রাখি। এখন দেখি অফিসে তালা।
কাননচক গ্রামের লিপি মন্ডল বলেন, ‘রেনেসাঁ এন্টারপ্রাইজের মালিক আনন্দ মোহন বিশ্বাসের শ্যালক সুশাংশু শেখর সদাইয়ের কথামত ৪ লাখ ৭ হাজার টাকা এককালীন বিনিয়োগ করি। বাবা অনাদী মন্ডল জায়গা বিক্রি করে তার নামে দেড় লাখ টাকা জমা রাখেন। লাভ না দিলেও মূল টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন লিপি।
রেনেসাঁ এন্টারপ্রাইজের মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করা প্রশান্ত মন্ডল বলেন, ‘আমরা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছি। মালিকপক্ষ গাঢাকা দিয়েছেন। গ্রাহকদের জমাকৃত টাকা ফেরত না দেওয়ায় আমরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি।
এ ব্যাপারে জানতে রেনেসাঁ এন্টারপ্রাইজের পরিচালক আনন্দ মোহন বিশ্বাসের মুঠোফোনে ফোন দিলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
অপরদিকে রেনেসাঁ এন্টারপ্রাইজের পরিচালক (বিজনেস অপারেশন ম্যানেজার) প্রবীর বিশ্বাস ওরফে তারকের মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হালিশহর এলাকায় আনন্দ মোহন বিশ্বাসের বাড়িতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে আনন্দ মোহনের পরিবারের কোন সদস্য নেই। তবে স্থানীয়রা বলছে আনন্দ মোহন বিশ্বাস, স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে খুলনায় অবস্থান করছেন। সুযোগ বুঝে ভারতে পালিয়ে যাবেন।
এই ধরণের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক চিতলমারী উপজেলায় থাকা একটি তফসিলি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, রেনেসা এন্টারপ্রাইজ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন-১৯৯৩ স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। তাকে আইনের আওতায় আনা উচিত। তার যেহেতু ট্রেডলাইসেন্স ছাড়া সরকারি কোন দপ্তরের নিবন্ধন ছিল না এজন্য উপজেলা প্রশাসন তাকে আইনের আওতায় আনতে পারে। বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে গ্রাহকদেরকে আরও সচেতন হওয়ার আহবান জানান এই ব্যাংক কর্মকর্তা।
চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাপস পাল জানান, অভিযোগগুলো ক্ষতিয়ে দেখে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।