আজ ৪ ডিসেম্বর শেরপুরের ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুরের ঝিনাইগাতী অঞ্চলকে শক্রমুক্ত করে। পাক-হানাদার বাহিনী ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার বুকে হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ শে মার্চ সকালে ছাত্রনেতা ফকির মান্নান, আব্দুল কাফি মিয়া, হারুনুর রশিদ (রশিদ মাষ্টার), সৈয়দ আলী মেম্বার, বাবু অনন্ত কুমার রায়, সেকান্দর আলী ফকির সহ অনেকেই ওয়্যারলেস অফিসে এসে পৌঁছান। ইংরেজীতে লেখা বঙ্গবন্ধুর টেলিগ্রাম ম্যাসেজটি পেয়েই নেতৃবৃন্দ তা শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরণ করেন।
শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ হাতে পেয়েই তা বাংলায় অনুবাদ করে শেরপুর নিউ মার্কেট মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত সমাবেশে পাঠ করে শোনানো হয়। সমবেত জনতা মুর্হুমুর্হু শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে শেরপুরের আকাশ-বাতাস।২৭ মার্চ সকালে শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এডভোকেট আব্দুল হালিম এমপি, মুহসিন আলী মাস্টার ও ছাত্র নেতা আমজাদ আলী ঝিনাইগাতী এসে পৌঁছেন। ঝিনাইগাতীর নেতৃবৃন্দ তাদের অভ্যর্থনা জানান। ছাত্রনেতা ফকির আব্দুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে তারা নকশি ইপিআর ক্যাম্পে যান। নকশি ক্যাম্পের সুবেদার হাকিম নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করাসহ পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে রাংটিয়া পাতার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ট্রেনিং শেষে এসব স্বেচ্ছাসেবক সহ মুজিব বাহিনী ও ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে সুবেদার হাকিম মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে তা পিছু হটে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের চরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২৬ এপ্রিল সুবেদার হাকিম এর খোলা জীপ এসে দাঁড়ায় ঝিনাইগাতী আমতলায়। সুবেদার হাকিম জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ জানান। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইগাতী শত্রুমুক্ত ছিল। ২৭ এপ্রিল পাক বাহিনী বহর নিয়ে গোলা বর্ষণ করতে করতে পৌঁছায় ঝিনাইগাতী বাজারে। ঝিনাইগাতী ঢুকেই আওয়ামী লীগ অফিস আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐদিন বিকালেই কোয়ারীরোডে পাক বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে ঝিনাইগাতী সদরের এক মাইল দক্ষিণে আহম্মদনগর হাই স্কুলে তাদের সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে। এছাড়া পাক বাহিনী শালচূড়া, নকশী, হলদীগ্রাম, তাওয়াকোঁচা, মোল্লাপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৬ বৈশাখ জগৎপুর গ্রামে হানা দিয়ে গ্রামটি পুড়িয়ে দেয় এবং পাক বাহিনী ৪১জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে।
৫ জুলাই কাটাখালি ব্রীজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা। দালালদের খবরে পাক বাহিনী রাংগামাটি গ্রামে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। সম্মুখ যুদ্ধে কমান্ডার নাজমুল আহসান শহীদ হন। তাঁর লাশ আনতে গিয়ে আলী হুসেন ও মোফাজ্জল শহীদ হন। পরদিন গ্রামে হানা দিয়ে পাক বাহিনী ৯ জন গ্রামবাসীকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ২৩ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা তাওয়াকুচা ক্যাম্প দখল করে এবং মুক্ত তাওয়াকুচায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তাওয়াকুচা যুদ্ধে ৪ জন পাক সৈন্য ও ৭ জন রাজাকার নিহত হলে পাক বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে। ৩ আগস্ট নকশি ক্যাম্প আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা। আগের দিন মেজর জিয়া নকশি ক্যাম্প আক্রমণের জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের অবস্থানগুলো দেখেন। এদিনের যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও নিখোঁজ হন। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। ২৭ নভেম্বর কমান্ডার জাফর ইকবালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী বাজারের রাজাকার ক্যাম্প দখল করে ৮টি রাইফেলসহ ৮ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পাক বাহিনী ঝিনাইগাতী হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবিএম সিদ্দিকের ছোট ভাই ওমর (১১) ও মুক্তিযোদ্ধা মকবুলের পুত্র খালেক (১০), পাক বাহিনীর দালাল আব্দুর রহমান, গোজারত মেম্বারসহ ৮ জনকে আহম্মদনগর ক্যাম্পের বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের এক গর্তে মাটি চাপা দিয়ে পুঁতে রাখে। ৩ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টায় শালচূড়া ক্যাম্পের পাক বাহিনী কামালপুর দুর্গের পতনের আগাম সংবাদ পেয়ে পিছু হটে এবং আহম্মদনগর হেড কোর্য়ারটারের সৈনিকদের সাথে নিয়ে রাতেই মোল্লাপাড়া ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। এভাবে রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত হয়।৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ায়। তাই প্রতি বছর ৪ডিসেম্বর ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচী পালন করেন, ঝিনাইগাতী উপজেলা মুক্ত দিবস উদযাপন কমিটি।
আজ ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস
শীর্ষ সংবাদ: