রাজধানীর ডেমরায় ব্যবসায়ী মো. রাজীবুল আলম ভূঁইয়া ওরফে রাজীবের চোখ উপড়ে ফেলার চাঞ্চল্যকর মামলায় পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। রায় ঘোষণার পর জানা যায়, যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত এই পাঁচ আসামি এখনও পলাতক। রবিবার (১ নভেম্বর) আদালতে এই রায় ঘোষণা করা হয়। মামলার মোট ১০ আসামির মধ্যে পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, চারজনকে বেকসুর খালাস এবং প্রধান আসামি রুবেলকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।
এলাকাবাসী, ভূক্তভোগী পরিবার ও মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৭ নভেম্বর রাত প্রায় পৌনে ৯ টার দিকে ডেমরার বড়ভাঙা বোর্ডমিল এলাকা থেকে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন ব্যবসায়ী মো. রাজীবুল আলম ভূঁইয়া ও তার বন্ধু লিটন। পথে বড়ভাঙা ক্যানেলপাড় এলাকায় আনোয়ার ভিলার কাছে পৌঁছালে রিকশা থামিয়ে দুর্বৃত্তরা রাজীব এবং লিটনকে একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যায়। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে রাজীব ও লিটনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় তারা। এরপর রাজীবকে হাত-পা বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দেয়। মুখে গুঁজে দেওয়া হয় গামছা, যাতে তিনি কোনোভাবে চিৎকার করতে না পারেন। এরপর সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিজয় ওরফে শামীম ধারালো অস্ত্র দিয়ে রাজীবের এক চোখ উপড়ে ফেলে সেটি মাটিতে ছুড়ে ফেলে। এ দৃশ্য দেখে প্রাণভয়ে পালানোর চেষ্টা করেন লিটন, তবে তাকে আবার ধরে আনা হয়। ঠিক একইভাবে রাজীবের অন্য চোখও উপড়ে ফেলা হয়।
মামলার প্রধান আসামি রুবেল, যিনি পরে ২০১০ সালের ১৬ মার্চ র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ঘটনার সময় কিছু লোক দূর থেকে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। একজন চিৎকার করে র্যাবকে খবর দেওয়ার কথা বললে দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে র্যাব—১০ এর একটি দল এসে রাজীবকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা জানান, রাজীবের দুটি চোখ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে ভবিষ্যতে সেগুলো আর প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। চিরতরে অন্ধ হয়ে যান রাজীব। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর রাজীবের বাবা শাহ আলম ডেমরা থানায় তখন একটি মামলা দায়ের করেন।
এ বিষয়ে ভূক্তভোগী রাজীব জানান, তিনি স্নিগ্ধা মাল্টিপারপাস নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। ইট-বালু সরবরাহের পাশাপাশি কয়েকটি গাড়ি এবং একটি মাছের খামার করেছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যবসা পরিচালনা করলেও সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলার পর তার জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। হামলাকারীদের সবাই তাদের এলাকা ও আশপাশের বাসিন্দা। এরা দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে রাজীব প্রায়ই প্রতিবাদ করতেন। এমনকি পুলিশকে খবর দিয়ে ওই সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতেও সাহায্য করেছিলেন। এই কর্মকাণ্ডের জেরে রাজীব স্থানীয় সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হন। তাদের প্রতিশোধের ফলস্বরূপ ২০০৮ সালের ২৭ নভেম্বর রাতের সেই ভয়াবহ হামলা ঘটে, যা চিরতরে বদলে দেয় তার জীবন।
রাজীবের স্ত্রী মলি আক্তার জানান, ২০০৮ সালের ২৭ নভেম্বর ছিলো ভয়ংকর এক রাত, সে দিন চিরতরে অন্ধ করে দেয়া হয় তার ভালোবাসার মানুষ রাজীবকে। রাজধানীর ডেমরায় সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করে দুটি চোখ উপড়ে ফেলে। এমনভাবে যেন তিনি বাকি জীবনে আর কখনও পৃথিবীর আলো দেখতে না পারেন। এই ঘটনা শুধু রাজীবের জীবন নয়, তার স্বপ্নকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। মলির পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি বন্ধুরাও তাকে রাজীবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ভালোবাসার টানে এবং রাজীবের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সবাইকে উপেক্ষা করেন।
ভয়াবহ ওই ঘটনার মাত্র দুই সপ্তাহ পর, ১৪ ডিসেম্বর মলি সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে রাজীবকে বিয়ে করেন। কলেজছাত্রী মলি বিয়ের দিনই শপথ নেন, তিনি আইনজীবী হবেন এবং স্বামীর ওপর হওয়া এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। সেই প্রতিজ্ঞার পথ মোটেও সহজ ছিল না। মলি ও রাজীব দুজনকেই একদিকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের হুমকি আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। তবে মলি তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তিনি আইনজীবী হয়ে স্বামীর হয়ে লড়াই করেন।
জানা যায়, মামলাটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ডেমরা থানার পুলিশ পরিদর্শক মীর আতাহার আলী ১০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এতে ডেমরা থানা এলাকার বাসিন্দা রুবেল, বিজয় ওরফে শামীম আহম্মেদ, দ্বীন ইসলাম, মো. ইকবাল, নাছু ওরফে নাসির উদ্দিন, রাজিব ওরফে মোটা রাজিব, রিপন, রাশেদ, তপন ও রাসেল ওরফে রোসেল ওরফে মমিতুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ৯ আসামির (২০১০ সালে রুবেল নিহত হন) বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। বিচার চলাকালে মামলার প্রাসঙ্গিক তথ্য উপস্থাপনে ২৪ জন সাক্ষীর তালিকা থেকে ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর, গত রোববার (১ নভেম্বর), ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলামের আদালতে রাজীবুল আলম ভূঁইয়ার ওপর সন্ত্রাসী হামলার মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। মামলার ১০ আসামির মধ্যে প্রধান আসামি রুবেল ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আদালত প্রমাণের ভিত্তিতে ৫ জন আসামি বিজয় ওরফে শামীম আহম্মেদ, দ্বীন ইসলাম, মো. ইকবাল, নাছু ওরফে নাসির উদ্দিন, রাজিব ওরফে মোটা রাজিবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জরিমানা অনাদায়ে তাদের আরও তিন মাস কারাদণ্ড দেন।
অন্যদিকে, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার ৪ আসামি রিপন, রাশেদ, তপন ও রাসেলকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, এ ঘটনায় ৫ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাই তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তবে ধারালো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রাজীবুলকে হত্যা না করায় বোঝা যায়, তাকে হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। এছাড়া খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, মামলার সঙ্গে রিপন, রাসেল, তপন ও রাশেদের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ মেলেনি। তাই তাদের খালাস দেওয়া হলো।
এদিকে, এ রায়ে ন্যায়বিচার পাননি বলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজীব। রোববার (১ নভেম্বর) রায় ঘোষণার আগে ইকবাল, মোটা রাজিব ও রাশেদ নামের তিন আসামিকে হাজিরায় উপস্থিত দেখানো হলেও রায় ঘোষণার সময় তাদের পলাতক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাজা প্রাপ্তদের দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন রাজীবের পরিবারের সদস্যরা।
ভুক্তভোগী রাজীব জানান, রায় ঘোষণার আগে আসামিদের উপস্থিতির সময়ই যদি পুলিশি হেফাজতে রাখা হতো, তবে সাজাপ্রাপ্তরা পালানোর সুযোগ পেত না। রায় ঘোষণায় চারজন আসামি খালাস পাওয়ায় রাজীব ও তার স্ত্রী, আইনজীবী মলি আক্তার, উচ্চ আদালতে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজীবের ভাষ্যমতে, ঘটনার সঙ্গে ১০ জন আসামিই সরাসরি জড়িত ছিল। চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তাও এটি প্রমাণ করেছেন। চার্জশিটে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে লড়াই করব। রাজীবের পরিবার এবং এলাকাবাসীর দাবি, এ ঘটনায় সব আসামিরই যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল। ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজীব ও তার স্ত্রী মলি আক্তার তাদের লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে জানান।
তাবিব