ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৭ বছর

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে চুক্তি বাস্তবায়ন চান পাহাড়ি জনগোষ্ঠী

জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০০:৩৪, ২ ডিসেম্বর ২০২৪

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে চুক্তি বাস্তবায়ন চান পাহাড়ি জনগোষ্ঠী

শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্যাঞ্চলে

শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্যাঞ্চলে। উল্টো বেড়েছে দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। এসব দূর করতে আঞ্চলিক দলগুলো শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানালেও সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিলের দাবি বাঙালি সংগঠনগুলোর। 
আধিপত্য বিস্তার, গুম-খুন, চাঁদাবাজি ও সংঘাতে এখনো উত্তাল পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি। চুক্তিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে পক্ষ-বিপক্ষ। একপক্ষ বলছে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে শান্তি ফিরবে। আরেক পক্ষ বলছে, শান্তিচুক্তি সাংঘর্ষিক। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাহাড়ের বাসিন্দাদেরও। এতে বারবার পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কাক্সিক্ষত শান্তির দেখা মিলছে না।  
৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পার্বত্য চুক্তির মৌলিক ধারাসমূহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আশাবাদী সাধারণ পাহাড়িরা। তবে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পার হলেও পাহাড়ে বন্ধ হয়নি অস্ত্রের ঝনঝনানি। পাহাড়ি তিন জেলায় সশস্ত্র ৬টি সংগঠনের আধিপত্যের লড়াইয়ে নিহত হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত ও উদ্বাস্তু হয়েছেন আরও অনেকে। গত তিন মাসে শুধু খাগড়াছড়িতে আধিপত্যের লড়াইয়ে নিহত হয়েছে ছয়জন। এর মধ্যে পানছড়ি উপজেলায় চারজন ও দীঘিনালায় দুইজন। অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়ের উন্নয়ন ও শান্তির ধারা। এসব অবৈধ অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান সাধারণ মানুষ। 
এদিকে চুক্তির বর্ষপূতিতে এবার খাগড়াছড়িতে সরকারিভাবে কোনো কর্মসূচি নেই। তবে, জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ২ ডিসেম্বর শোভাযাত্রাসহ আলোচনা সভার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
উত্তাল পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতি জেএসএসের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দেয় সন্তু বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া পার্বত্য অঞ্চলে শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ। দুই যুগে শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পার্বত্যাঞ্চলকে সুরক্ষিত করতে ও কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে দুর্গম সীমান্ত এলাকায় নির্মিত হয় সীমান্ত সড়ক। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়েছে পাহাড়ের মানুষ। এ ছাড়া, পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমানে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু ২৭ বছরে আসেনি কাক্সিক্ষত শান্তি। আধিপত্য বিস্তারের জেরে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন দল।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ করে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সদস্যরা। তবে, চুক্তির বিরোধিতা করে একই বছর ২৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকে পাহাড় আবারও অশান্ত হয়ে ওঠে। ২৭ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ ভেঙে হয়েছে চারটি সশস্ত্র সংগঠন। এ ছাড়া বান্দরবানে কুকি চীন ও মগ পার্টি নামে আরও দুটি সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয়েছে। এসব দলের সদস্যরা চাঁদাবাজি, গুম, খুন ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬ সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর এ পর্যন্ত সহ¯্রাধিক মানুষ খুন হয় এবং ১৫শ গুম হয়। খুনের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, পাহাড়ে শান্তি চুক্তির পর ১৯৯৮ সালে চুক্তিবিরোধী যে সংগঠনের জন্ম হয় সেই সশস্ত্র সংগঠনটির হাতে ১৮৫ জন জেএসএস কর্মীসহ দুই শতাধিক লোক নিহত ও এক শতাধিক অপহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে জেএসএস এর হাতে প্রায় একই সংখ্যক ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের চার সংগঠনের কাছে এসেছে ৫ শতাধিক আধুনিক মারণাস্ত্র। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছেÑ এলএমজি, এসএমজি, একে৪৭ রাইফেল, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, ০.২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশীয় পিস্তল ও বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেড ও রকেট লাঞ্চারসহ আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। 
ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি সন্তোষিত চাকমা বকুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছার অভাবে চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রলম্বিত হয়েছে। চুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভূমি বিরোধসহ সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে। নতুন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা অনুধাবন করে ভূমি সংকট নিরসন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনসহ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসী শব্দ অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এমএন লারমার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা বলেন, চুক্তির ২৭ বছরেও বহু ধারা-উপধারা আজও অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। তারপরও তিনি আশা করেন, সহসাই পার্বত্য এলাকার হানাহানি বন্ধ হবে। ফিরে আসবে শান্তি, নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই প্রত্যাশা পাহাড়ের মানুষের। এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বলেন, পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত ও বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ে নতুন নতুন সৃষ্টি হওয়া আঞ্চলিক দলগুলো হত্যা, গুম ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকে। তাই পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ পার্বত্য চুক্তির সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিলের দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, এই চুক্তিতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। তাই,  বৈষম্যমূলক এ চুক্তি বাতিল করে পাহাড়ে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

×