সাগরের ভাঙন রোধে জরুরি প্রটেকশন দেওয়া জিও ব্যাগ ও টিউবে শ্রীহীন সৈকত
সাগরের অব্যাহত ভাঙনের কবল থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভাঙনরোধে স্থায়ী প্রতিরক্ষায় দুই যুগ ধরে সৈকত এলাকার সমীক্ষা শেষে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ শুধু প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রস্তাবনার কাজ চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ একাধিকবার ডিপিপি তৈরি করে প্রস্তাবনা আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
২০০৩ সাল থেকে এসব খবর গণমাধ্যমকে জানানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। শুধু ফি-বছর জরুরি প্রটেকশনের নামে সৈকতের শূন্য পয়েন্টের দুইদিকে তিন-সাড়ে তিনশ’ মিটার এলাকায় জিও টিউব ও জিও ব্যাগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। যা নিয়ে পর্যটকদের ক্ষোভ রয়েছে। হচ্ছে তাদের ভোগান্তি। ক্ষোভ রয়েছে কুয়াকাটার স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বিনিয়োগকারীদের।
সবশেষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০২৩ সালে ‘কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকতের ভাঙনপ্রবণ প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৭৫৯ কোটি ৫৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে। সমুদ্র তীর প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ৬৮টি গ্রোয়েন নির্মাণ, ট্যুরিজম পার্ক, মসজিদ-মন্দির এলাকার প্রতিরক্ষায় ৬০০ মিটার এলাকায় কাজ করা। এছাড়া দুই কিলোমিটার ৭০০ মিটার সি-বিচের স্লিপিং ডিফেন্স নির্মাণ করে প্রতিরক্ষা করা। কলাপাড়াস্থ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে আরও জানানো হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙনরোধ হবে। কিন্তু প্রকল্পটির আজ অবধি চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি।
এর আগে ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২১২ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করে সৈকতের শূন্য পয়েন্টের দুইদিকে পাঁচ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেখানে পরিকল্পনা ছিল গ্রীন সি ওয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে শোরলাইন বরাবর স্থির খাকবে। সৈকতের শেষভাগে গ্রিন সি ওয়ালের ওপর দিয়ে পর্যটকরা হাঁটাচলা করতে পারবেন। সি ওয়ালের ওপর ঘাস জন্মাবে। এটি হবে পরিবেশবান্ধব। হবে দৃষ্টিনন্দন। পর্যটক-দর্শনার্থীরা পারবে সি ওয়ালে বসে সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ। সি ওয়ালটি অবস্থানভেদে ২১ মিটার প্রস্থ এবং দুই-আড়াই মিটার উঁচু হবে। গ্রিন সি ওয়ালের সামনের দিকে উত্তাল ঢেউয়ের তা-ব ঠেকাতে নির্দিষ্ট এলাইনমেন্ট বরাবর সাগরের অন্তত তিন মিটার গভীর তলদেশে জিও টিউব বসানো হবে।
যার ফলে পলি জমে বিচের পরিধি আরও বাড়বে। প্রশস্ত হবে। এভাবে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার একের পর এক প্রকল্প পরিকল্পনা আর সমীক্ষা থেমে যায়। বর্তমানে সৈকতের চরম বেহালদশা। শুধু তিনশ’ মিটার নিয়েই জিও টিউব আর জিও ব্যাগের জরুরি প্রটেকশনের মধ্যে আটকে আছে। এসব জিও টিউব আর ব্যাগের বালু অনেকটা বের হয়ে গেছে। শ্যাওলা ধরে গেছে। প্রতিনিয়ত পর্যটকরা পা পিছলে পড়ে আহত হচ্ছে।
সূত্র মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের ১৭ দশমিক ২৫০ তম কিলোমিটার থেকে ৩৭ দশমিক ২৫০ তম কিমি পর্যন্ত বেড়িবাঁধের বাইরের দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার মূলত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকা নির্ধারণ করা রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গামতী লেকের ২৪ দশমিক ২৫০ তম কিমি থেকে আন্ধারমানিক নদী মোহনার ৩৪ দশমিক ৭৫০ তম কিমি পর্যন্ত সাড়ে দশ কিলোমিটার সৈকত সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। যেখানে মূলত পর্যটকরা বিচরণ করেন। এই সাড়ে দশ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ দশমিক ৪০০ কিলোমিটার থেকে ৩২ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচ দশমিক এক কিলোমিটার সাগরের তীব্র ভাঙন এলাকা। বর্তমানে সৈকতে ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচ কিলোমিটার অংশের মধ্যে আড়াই কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
যা রক্ষায় গেল বছর জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয় প্রায় দুই কিমি অংশে। তখন জিও টেক্সটাইল ব্যাগ দেওয়ার পাশাপাশি জিও টিউব দেওয়া হয়। কিন্তু এখন টিউব ও ব্যাগের বেহাল দশা। ঢেউয়ের তীব্রতায় ল-ভ- হয়ে গেছে। বেলাভূমে চলছে তীব্র ভাঙন। পর্যটকসহ সাধারণ মানুষ ও কুয়াকাটার বিনিয়োগকারীরা জানান, গোটা সৈকত রক্ষায় সাগরের তীব্র ভাঙন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া না হলে কুয়াকাটার দীর্ঘ সৈকত সাগরগর্ভে দ্রুত বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও থাকছে চরম ঝুঁকিতে। আর কবে নাগাদ মূলত স্থায়ী প্রটেকশনের প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হবে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ কেউ নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, কুয়াকাটার এখন মূল সমস্যা সৈকতের স্থায়ী প্রটেকশন দেওয়ার বিষয়টি। তারপর মেরিন ড্রাইভ। এসব হচ্ছে এখানকার মূল উন্নয়ন। সাগরের ভাঙনের ঝুঁকি থেকে সৈকতসহ গোটা কুয়াকাটার স্থাপনা সম্পদ রক্ষায় স্থায়ী পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাহ আলম ভুইয়া জানান, সৈকত স্থায়ী রক্ষায় ‘কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । যা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে।