আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৃহস্পতিবারও চট্টগ্রামে আদালত এলাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। সতর্কাবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ ওঠায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশাজীবী মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধ, মিছিল-মিটিং, ঘেরাও, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো হচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভয়ভীতি ছড়িয়ে দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পাঁয়তারা চালানোর অভিযোগ খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতি, পেশাজীবীদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের জন্য সহিংস পথ বেছে নেওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করার নেপথ্যে কোনো মহলের ইন্ধন বা উস্কানি আছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেই অভিযোগ করা হয়েছে।
ধর্মীয় সভা করে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর প্রতিবাদ ও দাবি-দাওয়া পেশ, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ঢাকায় তাকে গ্রেপ্তার, চট্টগ্রামে আদালতে আনা-নেওয়ার পথে রাস্তায় ব্যারিকেড, আদালতে শুনানির পর আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে খুন এবং খুনের ঘটনার পর চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার অভিযানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতির মাধ্যমে মহলবিশেষের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম খুনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানে গ্রেপ্তার, ইসকন নিষিদ্ধ করা এবং আইনজীবী হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে চট্টগ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। গত ৩১ অক্টোবর নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার এবং তাকে কারাগারে পাঠানোকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে তার অনুসারীরা নৃশংসভাবে খুন করে সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলামকে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনরোষের শিকার পুলিশের মনোবল এখনো পুরোপুরি চাঙ্গা হয়নি। পুলিশ সদস্যদের এখনো আতঙ্ক কাটেনি। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এখনো আগের মতো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না পুলিশ। এই সুযোগে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে রাজপথ দখল করে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসাধিককালের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ও সহিংসতা ঘটানো হচ্ছে।
এর আগে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাব, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও ধানম-ি এলাকা অবরুদ্ধ ছিল ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকদের আন্দোলনে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক। সোমবার শাহবাগে ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে লোক জমায়েতের চেষ্টা হয়েছে। ঋণ দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাদের ঢাকায় আনা হয়। একের পর এক দাবি-দাওয়ার হিড়িকে বেসামাল করে তোলা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে আদালত এলাকায় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সংঘর্ষের সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটে যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন মহল উদ্বেগের সঙ্গে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য আহ্বান জানান। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, হানাহানিসহ নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে বলেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। একই আহ্বান জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা মনে করছেন, এসবের পেছনে পতিত স্বৈরাচার এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের দোসররা নেপথ্যে থেকে ষড়যন্ত্র করছে। কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, ছাত্র সংঘর্ষ, ঢাকার বাইরে থেকে শাহবাগে লোকজন জড়ো করা, দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের কার্যালয় ঘিরে কর্মসূচি পালনের মতো ঘটনায় অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়কে বিক্ষোভ শুরু করে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বকেয়া বেতনসহ বিভিন্ন দাবিতে ভাঙচুর, ঘেরাও, বিক্ষোভ, মিটিং, মিছিল করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে গার্মেন্টস সেক্টর শান্ত হয়। তারপরও মাঝেমধ্যেই বিভিন্নস্থানে গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে তাদের দাবি-দাওয়া জানাচ্ছেন।
সম্প্রতি আনসাররা দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয় ঘেরাও, অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় এলাকায় বিক্ষোভ ও মিছিল, মিটিংও নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ডিএমপির এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মিছিল, বিক্ষোভ চলতে থাকে। গত কয়েকদিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। সেটি সমাধান করতে না করতেই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এর আগে ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন।
এর পর তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে সায়েন্সল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একই দিন সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার মালিকরাও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন। এর পর রাজধানীর জুরাইনে সড়ক ও রেললাইন অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে এবং দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার বা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের পাশাপাশি অক্সিজেন হিসাবে কাজ করেছে সেনাবাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে ঢালাও বদলির ফলে বদলি হয়ে আসা অধিকাংশ পুলিশ সদস্য রাজধানী ঢাকা শহরের অলিগলি চেনেন না, বিভিন্ন জেলা পুলিশের সোর্সের অভাব, কাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তাল মেলাতে পারছে না, জনবল ও গাড়ি সংকটসহ নানা অসুবিধার কারণে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন স্থানে এসে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বেশিরভাগেরই বড় ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে মোকাবিলার অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া পটপরিবর্তনের কারণে কেউ নিজে থেকে কঠোর পুলিশি অ্যাকশন নেওয়ারও নির্দেশনা দিতে চাইছেন না। এই সুযোগেই বিভিন্ন গোষ্ঠী সড়ক অবরোধ করে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। এছাড়া পুলিশের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না সাধারণ মানুষ। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ভয়ও ভেঙে গেছে। ফলে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে একটা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। একদিনে এত ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে না। এই ইন্ধনের পেছনে কারা জড়িত, আমরা তা তদন্ত করছি। বড় কোনো পরিকল্পনা না থাকলে একদিনে এত ঘটনা কাকতালীয় নয়। সরকার সফলভাবে কাজ করুক, এটা হয়ত অনেকেই চাইছে না। এখানে নানাপক্ষের পরিকল্পনা আছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশে নানা দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা ঘটছে। এটি মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথাও সরব, আবার কোথাও নীরব। দিনক্ষণ ও স্থান ঘোষণা দিয়েও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কেউ কেউ এসবের ভেতর ইন্ধনের কথা বলছেন। গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে ঘটনার পেছনেও কোনো ঘটনা রয়েছে কিনা।
তিনি বলেন, সংঘাত-সহিংসতায় জড়ালে কারও পরিচয় মুখ্য নয়, যেই হোক আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ডিসি তালেবুর রহমান বলেছেন, সবাইকে ধৈর্যশীল ও সহনশীল আচরণ করতে হবে। কোনো দাবি থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক মাধ্যমে উপস্থাপন করা যেতে পারে। চলমান পরিস্থিতিতে পুলিশ আইনের প্রতি যতœশীল হয়েই দায়িত্ব পালন করছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, সরকার শুরু থেকে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ছিল না। অনেকক্ষেত্রে তাদের নমনীয়তা বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সরকারকে ব্যর্থ এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে চক্রান্ত ও সহিংস অবস্থা তৈরি হতে পারে এমন শঙ্কা থাকার পরও সরকার তা শক্ত হাতে দমন করেনি। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।