ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ময়মনসিংহে কলকাঠি নাড়ছেন সাবেক এসিল্যান্ড

ভিপি সম্পত্তিতে বহুতল ভবন

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ২১:১০, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

ভিপি সম্পত্তিতে বহুতল ভবন

বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র স্টেশন রোডে সরকারি জমিতে ব্যক্তি মালিকানার বহুতল ভবন

ময়মনসিংহে সরকারি তালিকায় থাকা ভিপি সম্পত্তির ওপর ব্যক্তি মালিকানার বহুতল ভবন নির্মাণ নিয়ে তোলপাড় চলছে। নগরীর বাণিজ্যিক প্রাণ কেন্দ্র স্টেশন রোডের সরকারি জমিতে ব্যক্তি মালিকানার এই বহুতল ভবন নির্মাণে নেওয়া হয়নি সিটি করপোরেশনের কোনো অনুমোদন পর্যন্ত! এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে সিটি কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) ভূমিÑ বর্তমানে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের পিএস হিসেবে কর্মরত ইবনে মিজানসহ তৎকালীন সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে সরকারি জমি ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরে এই কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। 
অভিযোগ নগরীর ৩৪/বি, স্টেশন রোডের ‘গৌরহরি বস্ত্রালয়’-এর মালিকদের কব্জায় থাকা কোটি টাকা মূল্যের আলোচিত ভিপি জমিতে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে সহায়তা করেন তৎকালীন এসিল্যান্ড ইবনে মিজান। ‘করণিক ভুল’ উল্লেখ করে ভিপি তালিকায় থাকা জমির দাগসূচি সংশোধনসহ দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা খাজনা আদায়ের পথ সুগম করে দেন ইবনে মিজান। অথচ এর এক বছর পর বদলি হওয়ার একদিন আগে জমির পরিমাপে হিসাবের ‘গরমিল’ উল্লেখ করে এই দাগ সূচি সংশোধনের আদেশ বাতিল করে আবার খাজনা আদায় বন্ধ করে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

দাগ সূচি সংশোধনের পর আলোচিত জমির হোল্ডিং খুলে গৌরহরি বস্ত্রালয়ের মালিকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেন সাবেক পৌর ভূমি কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন। অথচ এর আগে বিগত ১৯৯১ সাল থেকে ভিপি তালিকায় থাকায় এই জমির খাজনা আদায় বন্ধ ছিল। সাবেক এসিল্যান্ড ইবনে মিজান ও সাবেক পৌর তহশিলদার ইখতিয়ার উদ্দিন অনিয়মে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে জানান, নিয়মমাফিক করা হয়েছে সবকিছু। এই ঘটনায় সাবেক পৌর তহশিলদারের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাবেক এসিল্যান্ড ইবনে মিজান। এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাননি ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল ইসলাম।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ টাউন মৌজার এসএ ১৮১২ নম্বর খতিয়ানের ৯৪৭৬ ও ৯৪৭৭ দাগে দশমিক শূন্য ৩৮৮ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন গৌরহরি বস্ত্রালয়ের মালিক প্রয়াত ননী গোপাল তালুকদার। একই মৌজার এসএ ১৭০১ নম্বর খতিয়ানের ৯৪৭৪ ও ৯৪৭৫ দাগে দশমিক শূন্য ৪৬৮ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন প্রয়াত বিধু ভূষণ দাস। 
পরবর্তীতে বিআরএস রেকর্ডে ১৫৫৬ নম্বর খতিয়ান খুলে ৭৮১৮  নম্বর দাগের দশমিক শূন্য ৪২৮ শতাংশ জমির মালিক হন প্রয়াত ননী গোপাল তালুকদারের পুত্র কৃষ্ণ গোপাল তালুকদার, শিব শংকর তালুকদার, নারায়ণ গোপাল তালুকদার ও বিষ্ণু পদ তালুকদার এবং বিআরএস ২৪২৮ নম্বর খতিয়ান খুলে ৭৮১৮ নম্বর দাগে শূন্য দশমিক ৪২৮ শতাংশ জমির মালিক হন প্রয়াত ননী গোপাল তালুকদার। এ হিসেবে ননী গোপাল তালুকদার ও তার চার পুত্রের নামে একই দাগে আলাদা দুটি খতিয়ানে মোট দশমিক শূন্য ৮৫৬ শতাংশ জমি বিআরএস রেকর্ডভুক্ত হয়। অথচ এসএ ১৭০১ নম্বর খতিয়ানের রেকর্ডীয় মালিক প্রয়াত বিধু ভূষণ পালের নামে থাকা ৯৪৭৪ ও ৯৪৭৫ দাগের দশমিক শূন্য ৪৬৮ শতাংশ জমির মধ্যে দশমিক শূন্য ৩৩১ শতাংশ জমি সরকারের ভিপি তালিকায় রেকর্ডভুক্ত ছিল।

যা সরকারের গেজেট ও দাগ সূচিতেও লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ নিয়ে গত ২০১৩ সালে এসএ ৯৪৭৫ দাগের জমি সরকারের ভিপি তালিকা থেকে অবমুক্তির জন্য অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন প্রয়াত ননী গোপাল তালুকদারের চার পুত্র। এ মামলায় বাদীর অনুকূলে রায় ঘোষণা করে ১১ ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে সরকার পক্ষে জেলা প্রশাসক আপিল করলেও উচ্চ আদালত বাদীর পক্ষে রায় বহাল রাখেন। তবে এ মামলায় বাদী এসএ ৯৪৭৫ দাগে দশমিক শূন্য ৩৩১ শতাংশ জমির বিপরীতে যে খতিয়ান উল্লেখ করেছেন বাস্তবে এই খতিয়ান নেই! বিষয়টি জানাজানি হলে মামলার বাদী পক্ষ রায় ঘোষণা মতে জেলা প্রশাসকের কাছে ১১ ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো আবেদন না করে ময়মনসিংহ সদর ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার ভূমি (এ্যাসিল্যান্ড) এর কাছে দাগ সূচী সংশোধনসহ ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহনের জন্য মিস কেস করেন।

আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন এ্যাসিল্যান্ড ইবনে মিজান ২০২২ সালের ১১ আগস্ট ‘করণিক ভুল’ হিসেবে দাগসূচি সংশোধন এবং ১৫৫৬ খতিয়ানের ৭৮১৮ দাগের দশমিক শূন্য ৪২৮ শতাংশ জমির মধ্যে ননী গোপালের নামে থাকা দশমিক শূন্য ১৩৭ শতাংশের কর আদায়ে গত ২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আদেশ দেন। এ আদেশে তৎকালীন পৌর ভূমি কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন হোল্ডিং খুলে এ আদেশের আগেই ২০২৩ সালের ৭ জুন আলোচিত ভূমির উন্নয়ন কর গ্রহণ করেন। 
পরবর্তীতে গত ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জমির পরিমাণে  হিসাবের ‘গরমিল’ উল্লেখ করে তৎকালীন এসিল্যান্ড দাগসূচি সংশোধনের আদেশ বাতিল ও আংশিক ভূমির আংশিক কর আদায়ের আদেশে গুঞ্জন ওঠে। ময়মনসিংহ পৌর ভূমি কর্মকর্তা  সিরাজুল ইসলাম জানান, দশমিক শূন্য ৪২৮ শতাংশ জমির মধ্যে ননী গোপালের নামে থাকা দশমিক শূন্য ১৩৭ শতাংশের আংশিক কর আদায়ে কোনা সুযোগ নেই। অথচ সাবেক এসিল্যান্ড ইবনে মিজান ১৫৫৬ খতিয়ানের ৭৮১৮ দাগের দশমিক শূন্য ৪২৮ শতাংশ জমির মধ্যে ননী গোপালের নামে থাকা দশমিক শূন্য ১৩৭ শতাংশের কর আদায়ে সাবেক পৌর ভূমি কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিনকে আদেশ দেন। এ্যাসিল্যান্ডের এমন আদেশ পালন করে এখন বিপাকে আছেন সাবেক পৌর ভূমি কর্মকর্তা।

একই অভিযোগে একাধিক তদন্তে ভূমি কর্মকর্তা হয়রানির শিকার হলেও এসিল্যান্ড রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। উল্টো ঘটনা ধামচাপা দিতে বিভাগীয় কমিশনারের পিএস হিসেবে নানা মহলে প্রভাব বিস্তার করছেন। একযাত্রায় পৃথক ফলের এমন ঘটনায় বিস্মিত ময়মনসিংহের সচেতন মহল। প্রশ্ন উঠেছে সাবেক এসিল্যান্ডের আদেশ তামিল করে সাবেক পৌর ভূমি কর্মকর্তা একের পর এক তদন্তের মুখোমুখি হলেও এসিল্যান্ড ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন? প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

গুঞ্জন উঠেছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের পিএস ইবনে মিজান সাবেক ভূমি কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিনকে হয়রানি করতে কলকাঠি নাড়ছেন। এদিকে বিতর্কিত জমির ওপর বহুতল নির্মাণে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কোন অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মানস বিশ্বাস।

×