জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ত্রাস সাখাওয়াত আলম মুকুল এখন কেথায়? জামালপুর-৪ সরিষাবাড়ী আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় বহুল সমালোচিত সাবেক এমপি ডা. মুরাদ হাসানের ডান হাত ও ছায়া এমপিখ্যাত স্থানীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সাখাওয়াত আলম মুকুলকে খোঁজছে তার নির্যাতনের শিকার হাজারো ভুক্তভোগী। সর্বশেষ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার পতনের পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন মুকুল।
তার ‘বস’ ডা. মুরাদ হাসানও এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানয় একাধিক সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুল-৪ সরিষাবাড়ী আসন থেকে দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ডা. মুরাদ হাসান। পেয়ে যান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব যদিও সেটি বেশিদিন টিকেনি। পরবর্তীতে হন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু সেখান থেকেও নারী ঘটিত কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্যহন ডা. মুরাদ হাসান।
ডা. মুরাদ হাসান দ্বিতীয় মেয়াদে এমপি হয়ে দৌড়ের ওপর থাকলেও সরিষাবাড়ীতে তার প্রতিনিধি সাখাওয়াত আলম মুকুলের ছিলো একছত্র রাম রাজত্ব। মুকুল সরিষাবাড়ীতে কায়েম করেছিলেন ত্রাসের রাজত্ব। উপজেলার সকল সরকারি বরাদ্দের হরিলুট, টেন্ডার বাণিজ্য, হাটবাজার ইজারা বাণিজ্য, যমুনা সার কারখানায় টেন্ডার বাণিজ্য, অবৈধ বালু উত্তোলন, নারী ক্যালেংকারী, সাংবাদিককে থানায় তুলে নিয়ে নির্যাতনসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা মুকুল করেননি।
এ সব বিষয়ে কেউ কোন শব্দ করলেই তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে চালাতেন নির্যাতন। নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর পাশাপাশি প্রশাসনকেও বড় হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করতেন। ডা. মুরাদ হাসানের আস্কারায় ধীরে ধীরে মুকুল হয়ে উঠেন সরিষাবাড়ীর ত্রাস। জানা যায়, সরিষাবাড়ী উপজেলার ভাটারা ইউনিয়নের চৌখা গ্রামের শাহজাহান আলী শেখের ছেলে সাখাওয়াত আলম মুকুল। সরিষাবাড়ী আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. মুরাদ হাসান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাড়ির ফরমায়েশ খাটতেন দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই মুকুল।
একপর্যায়ে ওই বাড়ির কাজের মেয়ে মোর্শেদা আক্তারকে বিয়ে করেন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুরাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে মনোনয়ন না দেওয়া হলে মুকুল পড়ে যান বিপাকে এবং জীবন জীবিকার তাগিদে অটোরিকশা, সিএনজি এবং ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার চালাতে শুরু করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. মুরাদ হাসান ফের এমপি নির্বাচিত ও প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হলে পুরো উপজেলায় কৌশলে একক আধিপত্য গড়ে তোলেন এবং পৌর নির্বাচনে সরিষাবাড়ী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের সবাইকে ক্ষমতার দাপটে মাঠছাড়া করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এই মুকুল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরিষাবাড়ী উপজেলা পরিষদের সকল দপ্তরে মুকুলের হাত ছিলো। তার অনুমতি ছাড়া একটি প্রকল্পও তালিকাভুক্ত হতো না। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের অধীনে বরাদ্দকৃত টিআর, জিআর, কাবিখা প্রকল্পের সবই মুকুলের পছন্দ মতো তালিকাভুক্ত করা হতো। তৎকালীন অতিদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দের ৪০ দিনের কর্মসংস্থান (ইজিপিপি) কর্মসূচির সিংহভাগ হরিলুট করা হয়েছিল তার নেতৃত্বে।
এছাড়া সোলার হোম সিস্টেম ও সেতু নির্মাণ কাজও মুকুলের পছন্দের লোকদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হতো। কয়েক ধাপে আশ্রয়হীনদের জন্য উপজেলায় কয়েক শতাধিক ঘর বরাদ্দ করে তৎকালীন সরকার। কয়েকটি ঘর বিনামূল্যে দেওয়া হলেও বেশিরভাগ উপকারভোগীর কাছ থেকে ঘুষ হিসাবে নগদ টাকা নিয়েছিল মুকুল বাহিনী। এই মুকুলের নেতৃত্বেই দেশের সর্ববৃহৎ যমুনা সার কারখানার এলাকায় দিনের পর দিন চলেছে নীরব চাঁদাবাজি।
প্রতিবস্তা সার পরিবহন বাবদ দুই টাকা হারে প্রতিমাসে অর্ধ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছের মুকুল। এছাড়া কারখানার ভেতরে চাঁদাবাজি, উৎকোচ বাণিজ্য, দৈনিক হাজিরার শ্রমিক নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যও ছিল কথিত মুকুল বাহিনীর হাতে। মুকুল বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। বাস টার্মিনাল এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার নিয়ন্ত্রণ অফিস। মুকুল বাহিনীর হামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের পদস্থ ও ত্যাগী সাধারণ নেতাকর্মীরাও।
২০২০ সালে বিজয় দিবস পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। এ সময় সাখাওয়াত আলম মুকুলের নেতৃত্বে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সেখানে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় মুকুল বাহিনী রফিকুল ইসলামের লোকজনের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন গুলিবিদ্ধ হয়ে চিরতরে একটি চোখ হারান।
স্থানীয়রা আরও জানান, একইভাবে মুকুল বাহিনী ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিন হোসাইন শিবলুর ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় সরিষাবাড়ী থানায় মামলা হয়। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি উপজেলার শিমলাবাজারে ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল হক তরফদারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর, স্বর্ণালঙ্কার লুট ও নারীসহ অন্তত ১০ জনকে মারধর করে মুকুল বাহিনী।
এদিকে মুকুল বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল চুরি সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করায় ২০২০ সালের ১০ এপ্রিল রাতে মুকুলের নেতৃত্বে সাংবাদিক নাসিম উদ্দিনের বাসায় ঢুকে তার স্ত্রীর সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশের সহায়তায় নাসিম উদ্দিনকে মধ্যরাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় ও সাংবাদিকতা বাদ দেওয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়।
শুধু নাসিম উদ্দিনই নয়। চাল চুরির সংবাদকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক মমিনুল ইসলাম কিসমতকে একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি দেয় মুকুল ও তার সন্ত্রাসীরা। বাংলা ১৪২৯ সনে পিংনা গোপালগঞ্জ হাটের দরপত্র উম্মক্ত করা হলে দরপত্র থেকে প্রশাসন প্রায় আড়াই কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও ১৪৩০ সনেই আবারও ক্ষমতার দাপটে প্রশাসন নির্ধারিত মাত্র ৮৮ লাখ টাকায় হাট ইজারা কব্জ করে নেন সাখাওয়াত আলম মুকুল।
এদিকে মুকুল বাহিনীর অত্যাচর নির্যাতনের শিকার শিকার বহু ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের হাতে গণধোলাই হওয়ার শঙ্কায় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই স্থানীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সাখাওয়াত আলম মুকুল গা ঢাকা দিয়েছেন। মুকুল গা ঢাকা দেওয়ায় গোটা সরিষাবাড়ী এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। তাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।