নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার মুর্তিমান আতঙ্ক নরোত্তমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম সিরাজ উল্যাহকে (৬০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার তাকে জেলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়েছে। এর আগে, বুধবার গভীর রাতে চট্টগ্রাম থেকে কবিরহাট থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার সিরাজ উল্যাহ নরোত্তমপুর ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রামের মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে। তিনি ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং বসুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল কাদের মির্জার শ্যালক।
জানা যায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী গা ঢাকা দেয় সিরাজ। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
কবিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.শাহীন মিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সিরাজ উল্যার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলাসহ ৪টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।
সদ্য সাবেক নোয়াখালী—৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দোর্দন্ড প্রভাবশালী একরামুল করিম চৌধুরী ওরফে একরাম—কাদের মির্জাকে প্রায় ১৬ বছরে শত কোটি টাকার আদায়কৃত চাঁদা দিয়েছেন সেই কুখ্যাত সিরাজ অবশেষে আটক হয়েছেন। সিরাজের আটকের খবরে বৃহস্পতিবার দিনভর কবিরহাট কোম্পানীগঞ্জে সকল হাট—বাজারে দ্রুত বিচারের দাবীতে ভুক্তভোগীরা মিছিল করেছে। চট্টগ্রাম পোর্ট ও বসুরহাট পৌরসভা, কবিরহাট পৌরসভা তথা নোয়াখালী—৫ আসনের কোম্পানীগঞ্জ—কবিরহাট উপজেলার সকল স্তরের এমনকি টয়লেট ইজারার টাকাও কুক্ষিগত করে ১৬ বছরে একরাম—কাদের মির্জা প্রায় হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন এই দুর্ধর্ষ সিরাজ। নিজেও হয়েছেন কোটিপতি।
ইট সরবরাহের নাম করে রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রকৌশলী হানিফসহ অন্ততঃ ২০ জন থেকে ২১ কোটি টাকার অধিক অগ্রীম টাকা গ্রহণ করে একটি ইটও সরবরাহ করেননি, এই ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার সিরাজ গ্রেফতারের খবরের তথ্যানুসন্ধান করতে সরেজমিনে এলাকায় গেলে হাজার হাজার ভুক্তভোগী গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে হাজির হন। তাদের একটাই অভিযোগ, ১৬ বছরে এ অঞ্চলের রাজা ছিলেন এই সিরাজ। সে নিজেকে গর্ভণর পরিচয় দিতো বলে জানা যায়। সময় বুঝে প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ এর উত্তরসূরী আটকা পড়লে তারই পত্নি পল্লি কবি জসিম উদ্দিনের মেয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক নির্বিক সততার মুক্ত প্রতীক হাসনা জসিম উদ্দিন মওদুদের শরণাপন্ন হয়ে উনার ভগ্নিপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক—ই—এলাহীরও ওনি সাহায্য নিয়েছেন। চাঁদার টাকার পরিমাণ বেশি হলে মিথ্যা অযুহাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ভূয়া নাম্বারে ফোন দিয়ে এবং ওবায়দুল কাদেরের নাম্বার ক্লোন করে বড় অঙ্কের টাকা গ্রহণ করেছেন। বিকেল ৪টায় হেমন্তের এই পড়ন্ত বেলায় প্রকৌশলী হানিফ জীবন—মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের আহাজারীতে পুরো ইউনিয়নের অসংখ্য লোক কান্না করে বলে, “আমাদেরকে ইট দিবে বলে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে টাকা দিয়েছি, কিন্তু তিনি ইটতো দেননি; দিয়েছেন হত্যার হুমকি!”
অবশেষে এক বছরের অধিক সময় পার হলেও আদালতের নির্দেশ তামিল করেছেন নোয়াখালী জেলা পুলিশ প্রশাসন
আদালত সূত্রে জানা যায়, বিগত এক বছর পূর্বে ফেনী থেকে নোয়াখালী পুলিশ প্রশাসনকে আদালতের রায় বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হলেও খুটির জোরে পুলিশ এই সিরাজকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
অপর দিকে সিরাজ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে উঠতি বয়সের তরুণদেরকে এনে রাতে দেহ ব্যবসার আসর বসাতেন। এতে বিশ^বিদ্যালয়—কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন। প্রকৌশলী হানিফ বলেন, “আমি এজমার রোগী, অনেক কষ্টে বিদেশের মাঠিতে ১২ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে যে ৩৩ লাখ টাকা এনেছি, মনের অন্তিম ছিল বাবা—মায়ের কবরের পাশে একটি দো’তলা বাড়ী বানাবো। কিন্তু ইটের জন্য সিরাজের সাথে মোবাইল ফোনে বা সরাসরি যোগাযোগ করলে সে টর্সার সেলের হুমকি দিতো।” টাকার অভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে জীবন—মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে হানিফের হতাভাগ্য স্ত্রী। চৌমুহনী সরকারি কলেজের ১৯৮০ সনের এই মেধাবী ছাত্র হানিফের স্ত্রী অজোরে কেঁদে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, “আপনারা যেভাবে হোক আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমার স্বামীর প্রাপ্য ৩৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণসহ যেন দ্রুত সময়ের পেতে পারি, আমার সন্তানরা কখনো এক বেলা, কখনো আধা বেলা খাচ্ছে মায়ের চিন্তায়।” কারণ মৃতু পথযাত্রী মা বলেন, কখন কবরের ডাক আসে। অন্ততঃ শেষ সময়ে স্বামী—সন্তানেরা তাদের প্রিয় মায়ের মুখে ঢাকার স্পেশাল হাসপাতালগুলোর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে শেষ রক্ষা পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন, এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু বিদিবাম গ্রেফতারের পরেও তার বাহিনী হুমকি অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে।
উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, সিরাজের অত্যাচার—নিপীড়নের ঘটনা সবকিছুকে হার মানাবে। তাঁদের নেতা—কর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ২৮ অক্টোবরের পর কোম্পানীগঞ্জে ৬৯ জন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা—কর্মীর বাড়িতে হামলা চালায় সিরাজের ইয়ংগার বাহিনী। এই বাহিনীর অত্যাচারে বসুরহাট বাজারের ব্যবসা—বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে।
বসুরহাট পৌরসভা ভবনের কাছাকাছি এবং অতিসন্নিকটে হলুদ রঙের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ ছিল সিরাজের টর্চার সেল। দলীয় কিংবা দলের বাইরে কারও সঙ্গে বনিবনা না হলে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাতেন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর জনৈক বসুরহাট বাজারের জিরো পয়েন্ট থেকে ধরে নিয়ে যায় সিরাজের সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রায় সাত ঘণ্টা পৌর ভবনের গোপন কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়।দখলেও পিছিয়ে ছিলেন না
উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের মুছাপুর ক্লোজার এলাকায় সিরাজের শত একরের বেশি খাসজমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দখলের পর ভুয়া ভূমিহীন সাজিয়ে ওই জমি আবার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
বাসিন্দারা জানান, মুছাপুর ক্লোজার এলাকার ছোট ফেনী নদী থেকে গত তিন বছরে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়। বিষয়টি দেখভাল করতেন মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী। দল ক্ষমতা ত্যাগের পর তিনিও পলাতক।
আবদুল কাদের মির্জার বড় পরিচয় তিনি সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার সাবেক এই মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
টানা সাড়ে ১৫ বছর দল ক্ষমতায় থাকাকালে সিরাজের কাছে জিম্মি ছিল গোটা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিরীহ জনগণ।
দল ক্ষমতায় থাকাকালে নিজ দলের প্রতিপক্ষ এবং বিরোধী দলের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিলেন সিরাজ। তাঁর বাহিনীর অত্যাচার—নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিএনপি—আওয়ামী লীগ দুই দলেরই নেতা—কর্মীরা। এমনকি ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী, পেশাজীবী মানুষ। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং গালমন্দ করা ছিল কাদের মির্জার নিয়মিত অভ্যাস। গঠন করেন ইয়ংগার বাহিনী ও হাতুড়ি বাহিনী।
ঠিকাদারি কাজে চাঁদাবাজি, সরকারি বিভিন্ন নিয়োগে তদবির—বাণিজ্য, শিশুপার্কের নামে কারখানা দখল, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিপণি বিতান ভাঙচুর, বিপণিবিতান বন্ধ করে দেওয়া, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
প্রায় চার বছর আগে দলের এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না বলে উপহাস করা সিরাজের সরকার পতনের পর নিজেই পালিয়েছেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে সিরাজের খোঁজ পাওয়া যাচ্চিল না।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও বসুরহাট পৌরসভায় যেকোনো উন্নয়নকাজ করতে গেলে সিরাজকে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো ঠিকাদারদের।
গত প্রায় ১৬ বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও বসুরহাট পৌরসভা ও কবিরহাট উপজেলায় মোট উন্নয়নকাজ হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে পৌরসভায় উন্নয়নকাজ হয়েছে প্রায় ৯৭ কোটি টাকার। আর বাকি উন্নয়নকাজ উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করে। প্রতিটি কাজে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন কাদের মির্জা। সেই হিসাবে কমিশনের টাকার অংক প্রায় ৩০ কোটি।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বেশির ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন সিরাজের ঘনিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা।
প্রাপ্ত কাজের ঠিকাদার গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সিরাজের এক লোক তাদেরকে পৌরসভা কার্যালয়ে ডেকে নিত। সেখানে ৫ শতাংশ কমিশনের বিষয়ে নিষ্পত্তি হতো। বাধ্য হয়ে ৫% টাকা দিতে হতো কাদের মির্জাকে।
বসুরহাট পৌরসভার অধীনে ২০১৪—১৫ অর্থবছরে বাস্তবায়িত হয় রাজাপুর স্কুল রোড বাইলেন রাস্তাসংলগ্ন পুকুরে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ এবং রাজাপুর স্কুল সড়কে প্যালাসাইটিং প্রকল্প। সরেজমিনে দেখা যায়, পুকুরে নির্মাণ করা প্রতিরোধ দেয়ালটির বেশির ভাগ অংশ ভেঙে পড়েছে পুকুরে। প্রতিরোধ দেয়াল ভেঙে পড়ার কারণে সড়কেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। সড়কের কিছু কিছু অংশ এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। এ কাজে উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের।
প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও কাজে আসছে না পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীর হাট—বসুরহাট সড়কের পশ্চিম পাশে (ইয়াকুব মার্কেটের উত্তরে) পুটিয়া খাল পর্যন্ত ৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত নালা ও বসুরহাট বাজারের দিঘির চারপাশে নির্মিত নালা।
বসুরহাট বাজারের কিছু সংখ্যক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী সিরাজের হামলা—নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো সাত্তার ব্রাদার্স (সাত্তার বেকারি), ফখরুল ক্লথ স্টোর, হুমায়ূন টিম্বার, ফিরোজ অ্যান্ড ব্রাদার্স, ফেন্সি হোটেল, আজমির হোটেল, গাজী অ্যান্ড সন্স, ছায়েদ ম্যানশন (৬ তলা বিপণিবিতান ও আবাসিক ভবন), মাওলা শপিং সেন্টার, মডার্ন হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, হেলাল হার্ডওয়্যার, সেলিম স্টোর, মেহরাজ প্লাজা। নানা অজুহাতে এগুলো বিভিন্ন সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বসুরহাট বাজারের আমিন মার্কেটের মালিক আশিক—ই—রসুলকে কাগজপত্র নিয়ে পৌরসভা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যান সিরাজ। পৌরসচিব সিরাজের নামে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে ওই মার্কেটের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন কাদের মির্জা। আশিক—ই—রসুল গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, টাকা দেওয়ার পর তাঁর মার্কেটের তালা খুলে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি এমন ছিল যে প্রতিকার পাওয়ার জন্য কারও কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
এ ছাড়া পৌর এলাকার রূপালী চত্বরে আবু ছায়েদ নামের এক লন্ডন প্রবাসীর চার ও ছয়তলার দুটি ভবন পাঁচ বছর আগে দখল করে নেন সিরাজ। চারতলা ভবনটি সিরাজ তাঁর স্ত্রীর নামে লিখে নেন। এসব ভবনের নিচে দোকান ও ওপরে আবাসিক ফ্ল্যাট। ছয়তলা ভবনটি থেকে পৌরসভার নামে ভাড়া তুলতেন সিরাজ। তবে সম্প্রতি ভবনটি দখলমুক্ত করেছেন আবু ছায়েদ।
বসুরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল মতিন ওরফে লিটন বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সিরাজের নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন। তাঁর অত্যাচারে জেলার অন্যতম একটি ব্যবসাকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা অনেকটা পথে বসার উপক্রম হয়েছিলেন।
কোম্পানীগঞ্জের মানুষের কাছে সবচেয়ে আতঙ্কের ছিল সিরাজের ইয়ংগার ও চেচা হাতুড়ি বাহিনী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের নেতা—কর্মীদের দমন এবং প্রবাসী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য এই বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৩ মে বসুরহাট পৌরসভার করালিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুরের অনুসারীদের দিকে তাঁর গুলি ছোড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে গ্রেপ্তার হলেও সিরাজের তদবিরে কিছুদিন পরই রাসেল জামিনে ছাড়া পান।
সিরাজের এই বাহিনীর হামলার শিকার হন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরনবী চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খিজির হায়াত খান, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান ওরফে রিপনসহ অনেকে।
কোম্পানীগঞ্জ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব পালনকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমানকে চলন্ত গাড়ির ভেতর কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা ছিল কাদের মির্জার। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। ওই সময় মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেওয়ারও সুযোগ ছিল না।
মিজানুর রহমান বলেন, কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না প্রশাসনের। তাঁর অপকর্মের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
গত বছরের ৩১ জুলাই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে সিরাজের ভাগনে রামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর মধ্যে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পৌরসভার কলালিয়া এলাকায় সিরাজের নেতৃত্বে হুমায়ূন টিম্বার মার্চেন্ট অ্যান্ড স মিলে হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। দুটি এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে ভেতরের বিভিন্ন মালামাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে মেয়রের অনুসারীরা সেখানে ‘শিশুপার্কের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখাসংবলিত একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন।
হুমায়ূন টিম্বার মার্চেন্ট অ্যান্ড স মিলের মালিক ফিরোজ আলম বলেন, ক্রয়সূত্রে তাঁরা জায়গার মালিক। কিন্তু হঠাৎ ওই জমি ‘খাস’ দাবি করে তাঁদের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলার পর আদালতের রায়ও অমান্য করেন কাদের মির্জা। পরে তিনি আবার আদালতে গেলে কাদের মির্জা দখল ছাড়েন।
সিরাজের বিরুদ্ধে খাসজমি দখলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, শুনেছি সিরাজতো এক মুর্তিমান আতঙ্ক। কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী ও মুছাপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার খাসজমি দখলকারীদের তালিকা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। দখলকারী যাঁরাই আছেন, তাঁদের উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিরাজের কাছে প্রশাসন ছিল অসহায়। কাদের মির্জার শত অপকর্ম জানার পরও জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ওবায়দুল কাদেরের নামে বরাদ্দ হওয়া টিআর, কাবিখা চাল/গম নিজের খেয়ালখুশিমতো প্রকল্প দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন সিরাজ। উন্নয়নকাজের ঠিকাদারিও কাদের মির্জার একক নিয়ন্ত্রণে ছিল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী বলেন, বসুরহাট পৌরসভাকেন্দ্রিক যত উন্নয়নকাজ, তার সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন সিরাজ। প্রতি মুহূর্তে প্রচণ্ড চাপে থাকতে হতো তাঁকে। একটু এদিক—সেদিক হলে তাঁকেও গালমন্দ করতেন।
বিগত ৫ আগস্ট ছাত্র—জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের খবরের সঙ্গে সঙ্গে সিরাজ তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাঁর বাড়িতে হামলা—ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সিরাজ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোথায় আছেন, তা এলাকার কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। তবে সিরাজ তাঁর পরিচিত ব্যক্তিদের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে এলাকা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন বলে জানা গেছে। সরকার পতনের পর সিরাজের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে।
নাহিদা