মাদারীপুর শহরে কলেজপড়ুয়া আকাশের মাছ-মাংসের ভ্রাম্যমাণ ‘কাবাব-ক্যাবি’ এখন বেশ জনপ্রিয়
সকালে কলেজে করেন লেখাপড়া, বিকেলে মাছ-মাংসের কাবাব বিক্রেতা, মাসে বিক্রি আড়াই লাখ, যা থেকে মাসিক লাভ ৬০ হাজার টাকা। মজাদার খাবার খেয়ে যেমন খুশি খাদ্যপ্রেমীরা, তেমনি খুশি কলেজপড়ুয়া মেহেদী হাসান আকাশ। শহরে শকুনি লেকেরপাড়ে অস্থায়ী ধাবা বসিয়ে নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ ও মাংসের কাবাব বিক্রি করেন আকাশ। এই ভ্রাম্যমাণ দোকানের নাম ‘কাবাব ক্যাবি’।
তার ‘কাবাব ক্যাবি’তে বিক্রি হয় নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছের কাবাব, হাঁসের কাবাব, চিকেন তন্দুরি, চিকেন বিবিকিউ, মসলাদার বটি কাবাব, অ্যারাবিয়ান রেশমি কাবাব, চিকেন হরিয়াল টিক্কা, মোরগ মাখ্যান, গরুর মাংসের শিক, বাদশাহী ললিপপ, মাসালা চিকেন চাপ, চিকেন মোমোস, নাগা মোমোস, ফ্রাইড মোমোস, লুচি, চাপতি পিঠা, শাহী পরোটা, চুই ঝাল, দেশী মুরগিসহ নানা মজাদার খাবার। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত চলে বিক্রি।
মাদারীপুর পৌর শহরের উকিলপাড়া এলাকার আলমগীর মুন্সি ও কাজল বেগমের ছেলে মেহেদী হাসান আকাশ (১৮)। বাবা ব্যবসা করেন। এক বোন ঢাকায় পড়াশোনা করেন। আকাশ মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। নিজে কিছু করবেন এবং মাদকের নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার ভাবনা থেকে শহরের শকুনি লেকেরপাড় ফুটপাতে শুরু করেন ‘কাবাব ক্যাবি’ নামে একটি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। প্রথমে কাবাব, লুচি বিক্রি শুরু করেন। এর পর হাঁসের মাংস ও পরোটা। দিন দিন বেচাকেনা বাড়তে থাকে।
খোলা জায়গায়, সুন্দর পরিবেশ ও খাবারের মান ভালো হওয়ায় অল্পদিনেই হাঁসের মাংসের চাহিদা বেড়ে যায়। এতেই আকাশের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। চিন্তা করেন নতুন নতুন আইটেম বাড়ানোর। পরে কুয়াকাটা থেকে কোরাল, রূপচাঁদা, টোনা, চিংড়ি, লইট্টা, কাঁকড়া, লাক্ষা, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ এনে তা ভেজে বিক্রি শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ সাড়া পড়ে যায়। লেকেরপাড়ে বসে সমুদ্রের মাছ ভাজা গরম গরম খেতে খুব পছন্দ ভোজনরসিকদের।
ভ্রাম্যমাণ চুলার সামনেই সমুদ্রের কাঁচা মাছগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। ক্রেতারা এসে তাদের পছন্দমতো মাছ খাওয়ার অর্ডার দেন। তখন তাদের সামনেই মাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়। পরে বিভিন্ন মসলা দিয়ে মাছ ভেজে ক্রেতাদের সামনে দেওয়া হয়। খাদ্যপ্রেমীরা মাছের সঙ্গে লুচি ও পরোটাও খেয়ে থাকেন। অনেকেই আবার মাছ ভেজে বাড়িতে পরিবারের জন্যও নিয়ে যান।
আকাশের প্রতিদিনের রুটিন সকালে কলেজে লেখাপড়া। এর পর দুপুরে বাসায় ফিরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বিকেলেই চলে আসেন লেকপাড়ে নিজের ‘কাবাব ক্যাবে’তে। ৬ জন কর্মচারী কাজ করেন এখানে। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা বিক্রি হয়। শুক্র ও শনিবার ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার খাবার বিক্রি হয়। শুক্র ও শনিবার লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে হয় ক্রেতাদের। প্রতি মাসে গড়ে তার আড়াই লাখ টাকার খাবার বিক্রি হয়। কর্মচারীর বেতনসহ যাবতীয় খরচ বাদে তার মাসিক লাভ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
স্থানীয় যুবক কে এম জুবায়ের হাসান খান বলেন, ‘আকাশ মাত্র একাদশ শ্রেণিতে পড়েন। এই অল্প বয়সে এভাবে ব্যবসার কথা চিন্তাই করা যায় না। আকাশকে দেখে আরও যুবক নিজেদের স্বাবলম্বী করতে এগিয়ে আসবেন বলে আমি মনে করি।’ খাবার খেতে আসা সোহাগ হাসান বলেন, আসলে সমুদ্রের মাছ এখানে পাওয়া যাবে, তা ভাবাই যায় না। শকুনি লেকেরপাড়ে বসে সমুদ্রের মাছের স্বাদ নেওয়াটা খুব আনন্দ ও মাজাদার ব্যাপার।’ অন্য ক্রেতা আয়াত হাসান বলেন, ‘কুয়াকাটা বা কক্সবাজারে গেলে সমুদ্রের মাছ খাওয়া যায়।
কিন্তু মাদারীপুর শহরে এই মাছ পাওয়া যায়, শুনে খেতে এসেছি। দারুণ মজা। আমি প্রায়ই আমার পরিবার নিয়ে এখানে মাছ খেতে আসি। তবে মাঝেমধ্যে হাঁসের মাংসও খাই। এখানকার সব রান্নাই মজাদার।’ ভোজনরসিক লাবণী বেগম বলেন, লেকেরপাড়ে অনেক রেস্টুরেন্ট থাকলেও এখানে খোলা পরিবেশে পরিবার নিয়ে খেতে ভালোই লাগে।’
‘কাবাব ক্যাবে’র স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান আকাশ বলেন, ‘আমি পড়াশোনার পাশাপাশি এই ব্যবসাটা শুরু করেছি। আমার বয়সের অনেকেই দেখি বাজে আড্ডা দেয়, নেশা করে। আসলে এগুলো আমার কখনই পছন্দ না। তাই ভালো সময় কাটানোর জন্য, নেশা বা বাজে আড্ডা থেকে দূরে থাকার জন্য এবং নিজের কর্মসংস্থানের জন্যই এই ব্যবসাটা শুরু করেছি। তা ছাড়া এখানে ৬ জনকে কাজের ব্যবস্থাও করে দিতে পেরেছি। তবে এভাবে ব্যবসাটা অল্প সময়েই সফলতা আসবে তা কখনো ভাবতেও পারিনি। আমাদের রান্না করা হাঁসের মাংস ও সামুদ্রিক মাছ ভাজা এখানকার মানুষের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শুক্রবার লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও খাবার খায় ক্রেতারা। তাই ক্রেতাদের পছন্দমতো আরও খাবারের আইটেম বাড়িয়ে ব্যবসাটাও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
মাদারীপুরের উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের নির্বাহী পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান খান বলেন, ‘আকাশ এত অল্প বয়সে পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা করছেন, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সকালে কলেজ করেন, বিকেলে ব্যবসায় করেন, বর্তমানে এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। আশা করছি তাকে দেখে আরও অনেক যুবক নিজের কর্মসংস্থান নিজেই খুঁজে নেবেন।’