ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

শত শত অনাথ কন্যার অভিভাবক নিঃসন্তান দুলাল

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০২:২৭, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

শত শত অনাথ কন্যার অভিভাবক নিঃসন্তান দুলাল

কেউ মা হারা, কেউ বাবা হারা। কারো আবার েনেই কেউ। এসব অনাথ মেয়েরা মাথা গোজার ঠাঁই পেয়েছে চাঁদমনি বালিকা কল্যাণ কেন্দ্র। পেনশনের টাকায় ২৫ বছর ধরে তাদের লালন-পালন করছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা পিজিরুল আলম দুলাল।

 

অনাথ মেয়েদের জন্য ১৯৯৯ সালে নীলফামারীর জলঢাকার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গী গ্রামে ১ একর ১০ শতাংশ জমির ওপর এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।নিঃসন্তান এই ব্যাংক কর্মকর্তা এখানে শত শত শিশুর অভিভাবক।

আশ্রমটিতে এতিম, অনাথ ও দরিদ্র মেয়েদের থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা ও খেলাধুলাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় অনেকে পাচ্ছেন উচ্চ শিক্ষার সুযোগ।

পিজিরুল আলম দুলাল ১৯৯৬ সালে উত্তরা ব্যাংকের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে চলে আসেন। নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজের অবহেলিত ও অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন থেকে পাঁচ অনাথ শিশুকে নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তিতে গড়ে তোলেন চাঁদমনি নামের একটি অনাথ আশ্রম।

তাদের লালন-পালন করতে গিয়ে নিজের জমানো অনেক অর্থের প্রয়োজন হলেও তাতে কোন আফসোস নেই দুলারের। তার যত্নের হাত যাদের স্পর্শ করেছে তাদের অনুভূতিতেও তিনি থাকেন সর্বদা।প্রত্যন্ত গ্রামের আশ্রমটিতে বর্তমানে বসবাস করছেন ৩০ অনাথ মেয়ে। তারা এখানে থেকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। পাশাপাশি সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা তাদের পড়াশোনা করান দুলাল। একই সঙ্গে যেসব শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়নি তাদেরও হাতেখড়ি দেন তিনি।

গত ২৫ বছরে আট শতাধিক মেয়ে এই অনাথ আশ্রম থেকে লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছেন। যাদের বাবা নেই, মা নেই অথবা বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই; এমন শিশুদের শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

সপ্তাহে চার দিন আলেম দিয়ে দেওয়া হয় কোরআন শিক্ষা। ছবি আঁকার ক্লাস হয় সপ্তাহে একদিন। মাসে দুইদিন শেখানো হয় গান। দেওয়া হয় হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণও।

আশ্রমে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, এখানে ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় আসছি। বর্তমানে ক্লাস এইটে পড়ি। আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। তারপর এখানে চলে আসছি। আমার বয়সী আমার গ্রামের অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি যদি এতদিন বাড়িতে থাকতাম হয়তো আমারও বিয়ে হয়ে যেত নয়তো আমি অন্য কোথাও কাজ করতাম। এখানে এসে পড়াশোনা করছি, এখানে খুব ভালো লাগে আমি পড়াশোনা করে চাকরি করেতে চাই।

আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, এখানে থাকতে অনেক ভালো লাগে। আমাদের নতুন কাপড় দেওয়া হয়। পড়াশোনার জন্য সব রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। আমি বড় হয়ে চাকরি করতে চাই। এখানে আমি বই পড়ি, আর্ট করি, টিভি দেখি, খেলা ধুলা করি। এবং গানও শিখি করি।

আশ্রমটিতে রান্না ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা মমিনা বেগম বলেন, এখানে রান্না করি। খুব ভালো লাগে। আমরা বাচ্চাদের দেখাশোনা করি। এখানে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছি। কারও অসুবিধা হলে হাসপাতালে নিয়ে যাই।

আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, প্রথমে আমি পাঁচটা মেয়ে দিয়ে শুরু করি। পরে দেখা যায় আরও অনেকে মেয়ে দিতে চায়। এভাবে ১৫টা মেয়ে আসলো। ১৫টা মেয়ে দিয়ে এভাবে ৩-৪ বছর চলল। তারপর এক পর্যায়ে ৩৫টা মেয়ে হলো। ৪৫ থেকে ৪৭ এর মতো মেয়ে এক সময় হয়েছিল। আশ্রমের নাম পরে দেওয়া হল ‘চাঁদমনি’। ‘চাঁদমনি’ মানে চাঁদের মতো শিশু। এটা কোনো রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান না। আমরা কোথাও কোনো রেজিস্ট্রেশন করিনি।

তিনি আরও বলেন, আশ্রমটিতে যারা ছিল বা থাকছে তারা দীর্ঘদিন ধরে আছে। কেউ ১০-১২ বছর ধরে, কেউ আবার ৩-৪ বছর ধরে। অনেকে আবার এক বছরে চলে গেছে। গড়ে ৪-৫ বছর ধরে থাকা মেয়ের সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন সময় আসছে গেছে এরকম মেয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। আর স্থায়ীভাবে যারা বসবাস করছে তাদের সংখ্যাও একশর বেশি। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে গেছে এদের সংখ্যা দুইশ এর বেশি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে কয়েকজন। আগের যে পরিমাণ মেয়ে আসতো আর যেত এখন কিন্তু অনেক কম আসে। করোনার পর থেকে দেখা যায় এখানে মেয়ে রাখার মানসিকতা কম। এর মূল কারণ হলো তারা গার্মেন্টসে পাঠাতে চায় বা কারও বাসায় রাখলে কিছু অর্থ পায়। সেজন্য হয়তো দিতে চায় না। এটা আমাদের ধারণা।

তিনি আরও বলেন, কয়দিন আগেও এখান থেকে দু’জন চলে গেছে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। সমাজের কতটা উপকার হচ্ছে আমি জানি না। তাতে কিছু দুস্থ মেয়ে প্রতিপালিত হচ্ছে। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি উদ্দেশ্য হলো যে মেয়েরা এখানে থেকে বর্তমান পৃথিবীর আধুনিকতার আবহাওয়া যেটার সঙ্গে তারা যেন মানিয়ে চলতে পারে। আমি অবসরের পর যে টাকা পেয়েছিলাম খুব বেশি না ১৫ লাখ টাকার মতো। আমার নিজের পৈতৃক কিছু সম্পত্তি ছিল ও কেনা কিছু সম্পত্তি ছিল সব এখানে দিয়ে দিছি। প্রথম ১০ বছর এখানে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি। দশ বছর ধরে কিছু লোক আমাকে সাহায্য করে। আমার দুইটা ভাগ্নি আছে তারাও আমাকে এখানে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে।

আশ্রমটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে হলরুম ও লাইব্রেরি। নিজ নিজ কক্ষে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। ক্লাসের বই পড়া ছাড়াও ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছোট গল্প, উপন্যাস ও গুণীজনদের জীবনী পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

এমএম

×