কেন্দ্র দখলের পর প্রতিদ্বন্দী তিনজন প্রার্থী এক হয়ে সিল মেরেছেন লাঙ্গল প্রতীকে। এমনকি তৎকালীন এমপি, নৌকার প্রার্থীও আছেন এই তালিকায়। এমনই এক অভিযোগে মামলা হয়েছে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানায়। কেবল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি আর ওয়ার্কার্স পার্টিই নয়, পদধারী নেতাসহ বিএনপি কর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে মামলায়।
এমনই এক হাস্যকর মামলা নিয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলাজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে।
এছাড়াও মামলাটি যিনি করেছেন তার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অন্য ইউনিয়নে। পাঁচজন সাক্ষীর মধ্যে চারজনের বাড়ি অন্য এলাকায়। প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই কি করে এধরনের অদ্ভুত একটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে সেই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ আমিনুল ইসলাম।
মামলার বাদী উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার হোসেন হেমায়েতও এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি। আর মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন উপজেলা বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতৃবৃন্দরা।
সরেজমিনে জানা গেছে, বাবুগঞ্জ থানায় গত ২১ নভেম্বর দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনের সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। মামলার অন্যন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, বরিশাল-৩ আসনের সাবেক এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও তৎকালীন মহাজোটের নৌকা মার্কার প্রার্থী শেখ মো. টিপু সুলতান এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ট্রাক প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করা যুবমৈত্রীর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান।
এছাড়া অন্য আটজন আসামির মধ্যে একজন বিএনপির পদধারী এবং অন্যরা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী। ১১ আসামির নাম উল্লেখের পাশাপাশি আরও দেড়শ’ জন ঘটনার সাথে জড়িত ছিলো দাবি করা হয়েছে মামলায়।
বাদি আনোয়ার হোসেন হেমায়েত তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আসামিরা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ঠাকুরমল্লিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে লাঙ্গলে প্রতীকে সিল মেরেছেন বলে উল্লেখ করেন। এসময় সেখানে বোমাবাজি, হামলা, মারধর, কুপিয়ে ও পিটিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের জখম করেছে বলে এজাহারে উল্লেখ করেন।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার খালিদ হোসেন স্বপন, সাবেক সভাপতি কাজী ইমদাদুল হক দুলাল এবং মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ফারজানা বিনতে ওয়াহাব। এরা তিনজনই বাবুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খালিদ হোসেন স্বপন বলেন, বর্তমানে কারাগারে থাকা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বাড়ি বাবুগঞ্জ উপজেলায়। তিনি একসময় এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের শরিক দল হিসাবে এখানে নৌকার প্রার্থী হয়ে ভোটে বিজয়ী হন ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট শেখ মো. টিপু সুলতান।
ওই নির্বাচনে পরাজিত হন জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য পদে থেকেই নির্বাচন করেন শেখ মো. টিপু সুলতান। তখন আসনটি লাঙ্গলকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি ছিল জাতীয় পার্টির। তবে তা না মেনে তৎকালীন এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ টিপু সুলতানকেই দেওয়া হয় নৌকা প্রতীক।
বিষয়টি নিয়ে জটিলতা হলে নেতাকর্মীরা যাকে খুশি সমর্থন দিতে পারবে বলে অঘোষিতভাবে জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এছাড়া ওই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করেন ওয়ার্কার্স পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান। গোলাম কিবরিয়া টিপু লাঙ্গল প্রতীকে এবং ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী এমদাদুল হক দুলাল বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন বরিশাল-৩ আসনে তুমুল প্রতিদ্বন্ধীতাপূর্ণ হয়।
সেবার নৌকা পেয়েও হেরে যান শেখ মো. টিপু সুলতান। ৫৪ হাজারের মতো ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন লাঙ্গল প্রতীকের গোলাম কিবরিয়া টিপু। শেখ মো. টিপু সুলতান পান ১৯ হাজারের কিছু বেশি ভোট। ৪৭ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন বিএনপির প্রার্থী জয়নুল আবেদীন। এছাড়া ট্রাক প্রতীকে ১৩ হাজারের মতো ভোট পান আতিকুর রহমান।
সাবেক এমপি শেখ মো. টিপু সুলতান বলেন, নির্বাচনের দিন আমি ছিলাম মুলাদী উপজেলায়। তাছাড়া রানিং এমপি আর নৌকার প্রার্থী হয়ে আমি কেন্দ্র দখল করে লাঙ্গলে সিল মারবো এমন অভিযোগ হাস্যকর।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারজানা বিনতে ওহাব বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের ভোটের হিসেব করলেই বোঝা যায় এ আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচন তুমুল প্রতিদ্বন্ধীতাপূর্ণ হয়েছিল।
তাছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থী আর নৌকার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী মিলে লাঙ্গলের প্রার্থীকে সাথে নিয়ে একটি কেন্দ্রে গিয়ে দলবেঁধে লাঙ্গলে সিল মারবে, এমন হাস্যকর মামলা তদন্ত ছাড়াই থানা কি করে নিল সেটার তদন্ত হওয়া দরকার।
উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মুকিতুর রহমান কিসলু বলেন, মামলার বাদির বাড়ি দেহেরগতি ইউনিয়নে। সেখান থেকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার দূরত্বে। মাঝে বড় একটি নদী পাড়ি দিতে হয়। বিএনপি নেতা হয়ে নিজের ইউনিয়ন রেখে ভোটের দিন সে (বাদি) কেন দশ কিলোমিটার দূরত্বের অন্য ইউনিয়নে আসলো সেটা মামলা গ্রহণের পূর্বে ওসির দেখা উচিত ছিল।
তাছাড়া সাক্ষী হওয়া পাঁচজনের মধ্যে চারজনের বাড়িও অন্য ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টির পাশাপাশি বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামি করার বিষয়ে বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আহবায়ক কমিটির সিনিয়র সদস্য ইসরত হোসাইন কচি বলেন, এই মামলার ব্যাপারে কিছুই জানা নেই।
আসামিদের তালিকায় ১১ নম্বর আসামি সোহেল সরদার মাধবপাশা ইউনিয়ন যুবদলের সহ-সভাপতি ও ইউনিয়ন তাঁতী দলের সাধারণ সম্পাদক। এটি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণেদিত। আমাদের দলেরই কেউ হয়তো অনৈতিক সুবিধা পেতে মামলাটি করিয়েছে।
ভোটের দিন নিজ ইউনিয়ন ছেড়ে ১০ কিলোমিটার দূরত্বের জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে কেন এবং কিভাবে গেলেন জানতে চাইলে মামলার বাদি আনোয়ার হোসেন হেমায়েত বলেন, মোটরসাইকেলে গিয়েছি। ভোটের দিন মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ছিল উল্লেখ করলে তিনি কথা ঘুরিয়ে নদীপথে ট্রলারে যাওয়ার দাবি করেন।
নৌকা আর ট্রাকের প্রার্থী এক হয়ে লাঙ্গলের পক্ষে ভোট ডাকাতি করার বিষয়টি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ আমিনুল ইসলাম বলেন, বাদীর অভিযোগ পেয়ে আমরা মামলা রেকর্ড করেছি। এখন তদন্ত করে দেখা হবে অভিযোগ সত্য নাকি মিথ্যা। এই মুহুর্তে এর বেশিকিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এমএম