ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

যমুনা রেলসেতুতে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ও ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

যমুনা রেলসেতুতে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু

যমুনা নদীর ওপর নবনির্মিত রেলসেতুতে মঙ্গলবার পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়

যমুনা নদীর ওপর নির্মিত রেলওয়ে সেতু দিয়ে মঙ্গলবার সকালে পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল) প্রথম  ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।  বাংলাদেশ রেলওয়ের মেগা প্রকল্প উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু দিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল) ট্রেন চলাচল শুরুর খবরে সিরাজগঞ্জসহ উত্তরের জেলাবাসীর মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাস বইছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
দেশের দীর্ঘতম এ রেলসেতুর ওপর দিয়ে সকাল ৯টা ৪২ মিনিটে ট্রেনটি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশের পূর্বপাড় ইব্রাহিমবাদ রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় সিরাজগঞ্জ প্রান্তে পৌঁছায় সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে।
 পরে ট্রেনটি ১০টা ২০ মিনিটে সিরাজগঞ্জ প্রান্ত সয়দাবাদ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে ১০টা ৪১ মিনিটে পূর্বপাড়ে ফিরে যায়। ট্রায়াল ট্রেন একটি ইঞ্জিন ও তিনটি বগি নিয়ে প্রথম যাত্রা শুরু করেছে। এই ট্রেনটি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে চলাচল করছে। প্রথমে ১০ কিলোমিটার বেগে চলাচল করলেও পরে ৪০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন দুটি সেতু পারাপার করছে। ধীরে ধীরে গতি বাড়বে এবং বাণিজ্যিক চলাচলে পূর্ণগতি ১২০ কিমি বেগে চলাচল করবে।
 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের পরিচালক আল-ফাত্তাহ মাসউদুর রহমান বলেন, দুটি ট্রায়াল ট্রেন সেতুর পশ্চিমপাড় থেকে পূর্বপাড়ে চলাচল করছে। প্রথমে ১০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে। পরে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলেছে। ধীরে ধীরে এর গতি বাড়ানো হবে। এভাবে বেশ কয়েকবার ট্রায়াল ট্রেনটি চলাচল করবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ নাইমুল জানান, ইতোমধ্যে রেলসেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চালানো শুরু করেছি। আগামী জানুয়ারিতে সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। এ সময় রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। যমুনা সেতু পূর্ব প্রান্তে ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে মঙ্গলবার ৯টা ৪০ মিনিটে পরীক্ষামূলক  ট্রেন চালানো হয়েছে। ওই ট্রেনটি সফলভাবে সেতুর প্রান্তে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে ১০টা ১৫ মিনিটে পৌঁছায়। পরবর্তীতে আরেকটি ট্রেন সেতুর পশ্চিম প্রান্ত সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১০টা ২০ মিনিটে ছেড়ে পূর্ব প্রান্তে ১০টা  ৪১ মিনিটে পৌঁছায়।
পূর্ব প্রান্ত থেকে চালানো ট্রেনের পরিচালক ছিলেন সুজন মিয়া এবং চালক মাসুদ রানা। আর পশ্চিম প্রান্ত থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনের পরিচালক ছিলেন বিশ্বজিৎ আর চালক মো. সুলতান।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের গতিসীমা। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু পারাপার হওয়ায় সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে সিডিউল বিপর্যয়। বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়।

পরে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়। এর মধ্যে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি ২ লাখ টাকা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ হিসেবে দিয়েছে। এ প্রকল্পের নির্ধারিত সময় ছিল ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু প্রথম সংশোধনে এ সময়সীমা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে স্থানান্তরিত করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন নেয়। 
টাঙ্গাইল ॥ পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলক চালু হলেও ট্রেনের পূর্ণগতি পেতে আরও সময় লাগবে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় একইসঙ্গে নদীর সিরাজগঞ্জ প্রান্ত থেকে একটি ও টাঙ্গাইল প্রান্ত থেকে একটি ট্রেন চালিয়ে পরীক্ষা করেন প্রকৌশলীরা। প্রথমে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার পরে ২০ কিলোমিটার ও শেষে ৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলানো হয় সেতুর ওপর দিয়ে। এদিকে ট্রেনের পরীক্ষামূলক উদ্বোধন উপলক্ষে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের দুই পাড়ের মানুষের মাঝে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।
পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের সময় কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি পাওয়া যায়নি বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মাসুদুর রহমানসহ প্রকল্পের দেশী ও জাপানি প্রকৌশলীরা। তিনি আরও জানান, বুধবারও বিভিন্ন গতিতে সেতু দিয়ে ট্রেন চালিয়ে পরীক্ষা করা হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সেতুটি ট্রেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। 
ট্রায়াল ট্রেনের চালক মইনুল ইসলাম বলেন, আমার খুব ইচ্ছে ছিল প্রথম ট্রেনটি আমি চালাব। ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
জানা যায়, নির্মাণাধীন রেল সেতুটি চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ বা শেষের দিকে উদ্বোধনের কথা থাকলেও এ বছর তা হচ্ছে না। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে উদ্বোধনের পর দ্রুত বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচলের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
যমুনা রেলওয়ে সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিডি) আল ফাত্তাহ মাসুদুর রহমান জানান, গত সোমবার থেকে ট্রায়াল ট্রেন শুরু হলেও মঙ্গলবার সকালে উদ্বোধনী ট্রায়াল ট্রেন পরিচালনা করা হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত ট্রায়াল ট্রেন চলবে। দেশের এই দীর্ঘতম রেল সেতু দিয়ে বিরতিহীনভাবে কমপক্ষে ৮৮টি ট্রেন দ্রুতগতিতে সেতু পার হতে পারবে। ফলে সেতু পারাপারে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় বাঁচবে।
রেল সেতু রেলওয়ে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণাধীন যমুনা রেল সেতু সাধারণ ট্রেন ছাড়াও দ্রুতগতির (হাইস্পিড) ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে সেতুতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তবে উদ্বোধনের প্রথম বছরে সাধারণত ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে। এতে ক্রসিংয়ের সমস্যা হবে না, ফলে সময় সাশ্রয় হবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট।

বিগত ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এর মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দাঁড়ায়। যার মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ দেশীয় অর্থায়ন এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে।

×