নতুন ফসল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে উৎসবের আয়োজন করা হয়
জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের গারো সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টির অন্যতম প্রধান উৎসব ‘ওয়ানগালা’। নতুন ফসল ঘরে উঠানোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর পালন করা হয় এ উৎসব। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ বছর ২৩ ও ২৪ নভেম্বর দুদিনব্যাপী ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীতে অনুষ্ঠিত হলো ওয়ানগালা উৎসব। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খ্রিস্টভক্ত এবং গারাগানজিং, কতুচ, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদক ও আরেং নামে ১২টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের শত শত লোক অংশ নেন। গারো সম্প্রদায়ের কয়েকশ’ মানুষ দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করেন।
জানা যায়, গারোদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে। একসময় গারো পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’কে উৎসর্গ করে এ ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন করা হতো। গারো সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, তাদের শস্য দেবতা একসময় পাহাড়ি এলাকার গারোদের হাতে কিছু শস্য দিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা এটা রোপণ কর তাতে তোমাদের আহারের সংস্থান হবে এবং তোমরা যে শস্য পাবে তা থেকে সামান্য কিছু শস্য আমার নামে উৎসর্গ করবে।’ এরপর থেকেই গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছিল। কিন্তু গারো পাহাড়ের অধিকাংশ গারো ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয় এ উৎসব। এখন নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন তারা। সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলার গারো পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠীর বা আদিবাসীরা মনে করেন, ঈশ্বরের দয়ায় তারা ফসল উৎপাদন করে থাকে। তাই তারা প্রতি বছর আয়োজন করে থাকে নবান্ন বা গারোদের ভাষায় ওয়ানগালা উৎসব।
বকশীগঞ্জ
সংবাদদাতা, বকশীগঞ্জ, জামালপুর থেকে জানান, জামালপুরের বকশীগঞ্জ পাহাড়ি সীমান্তের আদিবাসী জনপদে ২৪ নভেম্বর রবিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়ানগালা উৎসব। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ওই ওয়ানগালা। নবান্নে শস্য দেবতাকে ফসলের কিছু অংশ তুলে দিতেই আদিবাসী সম্প্রদায় এই ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন করে। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত উৎসবের আমেজ থাকে বকশীগঞ্জের পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে। শুধু পাহাড়ি নয় এই উৎসবে অংশ নেয় বাঙালিরাও।
আদিবাসীদের বিশ্বাস, শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’ এর ওপর নির্ভর করে ফসলের ভালো ফলন হয়। তাই ওই শস্য দেবতার প্রতি দয়ার প্রার্থনা জানিয়ে নতুন ফসল আহারের অনুমতি প্রার্থনা করা হয়। জামালপুরের ভারতীয় সীমান্তবর্তী বকশীগঞ্জের দিঘলাকোনা এলাকায় ওয়ানগালা উৎসব পালন করেছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের পাহাড়িরা।
ওয়ানগালার শুরুতে থক্কা অনুষ্ঠান, শস্য দেবতার উদ্দেশে ফসল উৎসর্গ, প্রবেশগীতি, প্রার্থনা, বাণীপাঠ, উপদেশ ও অর্পণগীতিসহ নানা আয়োজন করে দিঘলাকোনার সাধু আন্দ্রে ধর্মপল্লী। সেখানে অংশ নেয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের পাঁচ শতাধিক বাসিন্দা। উৎসবটিকে ঘিরে আনন্দের মেলায় পরিণত হয় পুরো ধর্মপল্লী।
আদিবাসী সম্প্রদায় ছাড়াও ওই ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে অংশ নেয় এই পাহাড়ি এলাকার সাধারণ বাঙালিরাও। সব পরিবারের ভালোবাসা, আনন্দ এবং দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল কামনা করা হয় ওয়ানগালার প্রার্থনা অনুষ্ঠানে। নৃত্য পরিবেশন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দিগলাকোনা এলাকায় বসেছে মেলা।
ঝিনাইগাতী
সংবাদদাতা ঝিনাইগাতী, শেরপুর থেকে জানান, শেরপুরে নৃ-জনগোষ্ঠী গারোদের অন্যতম প্রধান উৎসব ‘ওয়ানগালা’। নতুন ফসল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে রবিবার সকালে ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত ফসল দেবতা মিসি আর সালজং-এর উদ্দেশে উৎসর্গ করে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারোদের নিজস্ব ভাষায় গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়। দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে র্যাফেল ড্র ও বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।