কিরণ
মাত্র সাত শ’ টাকা বেতনের বুক বাইন্ডার (কর্মচারী) থেকে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন স্কুল দপ্তরির ছেলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ। অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাবে বাগিয়েছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ। দু’দফায় হয়েছেন দেশের সর্ববৃহৎ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র। নির্বাচিত না হয়েও ওই দুই মেয়াদে মোট পাঁচ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কামিয়েছেন কয়েকশ’ কোটি টাকা ও সম্পদ। নিউইয়র্ক শহরে তিনটি বিলাসবহুল বাড়িসহ দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। অবৈধভাবে বালু নদী ভরাট করে দখল করেছেন বিশাল এলাকা। কমিশন বাণিজ্যের কারণে ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে একাধিক মামলায় অভিযুক্ত কিরণ গত মঙ্গলবার ভোরে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় যশোরের শার্শা উপজেলার শিকারপুর সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করে বিজিবির সদস্যরা।
বহুল বিতর্কিত ও আলোচিত আসাদুর রহমান কিরণের ফাঁসির দাবিতে গত মঙ্গলবার ও বুধবার গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ঝাঁড়ু ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপির ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে মিথ্যা মামলায় ২৭ মাস কারাগারে রাখেন তিনি, কেড়ে নেন মেয়রের পদ। বহু মিথ্যা মামলায় অধ্যাপক মান্নান ও তার নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গীর পাগাড় এলাকার বাসিন্দা আসাদুর রহমান কিরণের বাবা মরহুমর নূর মোহাম্মদ খান ছিলেন স্থানীয় একটি স্কুলের দপ্তরি। ১৯৮৫ সালের দিকে টঙ্গীর এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি কারখানায় বাইন্ডার পদে ৭০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন কিরণ। তার রাজনীতির হাতেখড়ি হয় জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর তার ওপরে উঠার সিঁড়ি খুলে যায়। ওই সময় তিনি জাতীয় যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরশাদ সরকারের সময় তিনি পরিচিতি পান ভূমিদস্যু হিসেবে। এরপর ২০০০ সালে বর্তমান গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান দ্বিতীয় মেয়াদে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে রাতারাতি তার ঘনিষ্ঠজন হয়ে যান কিরণ। পরবর্তীতে আজমত উল্লাহ খানের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। বাগিয়ে নেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ। টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনার হন আসাদুর রহমান কিরণ। তখনই তিনি অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সাবেক পৌর মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমতউল্লার ‘মাইম্যান’ হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার ভিত্তি তার পাকা হয়। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লা খান মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। অভিযোগ রয়েছে, ষড়যন্ত্র করে মেয়র পদ থেকে অধ্যাপক মান্নানকে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল কিরণের। অধ্যাপক মান্নান বরখাস্ত হওয়ার পর বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্যানেল মেয়র হয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পেয়ে যান কিরণ। এরপরই তার ভাগ্যের চাকা আরও গতি পায়। ভারপ্রাপ্ত মেয়র নির্বাচিত হয়ে ২৭ মাসেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন আসাদুর রহমান কিরণ। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম। এবারও নানা কূট কৌশলের কাছে হেরে নির্বাচনের কিছুদিনের মধ্যেই দল ও মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন জাহাঙ্গীর। এ দফায়ও ভারপ্রাপ্ত হয়ে মেয়রের চেয়ারেও বসেন কিরণ। মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সহ-সভাপতির পদও পেয়ে যান তিনি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর হয়েও তিনি প্রতাপের সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশন শাসন করেছেন দুই মেয়াদে প্রায় ৫ বছর। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এখন শত শত কোটি টাকার মালিক কিরণ।
অভিযোগ রয়েছে কিরণের প্রভাবের খুঁটি ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমতউল্লা খান। তাদের প্রশ্রয়েই কিরণ গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে পরিণত করেছিলেন লুটপাটের কেন্দ্রে। রাতারাতি দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। কথিত আছে, তার অবৈধ অর্থের ভাগ পেতেন জাহিদ আহসান রাসেল ও আজমতউল্লা খান।
স্থানীয়রা জানান, নানা অপরাধ ও মাদক কারবারে পৃষ্ঠপোষকতা, চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্য, দরপত্র ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স কম দেখানো, সিটি করপোরেশনের তহবিল আত্মসাৎ প্রভৃতিতে জড়িত ছিলেন আসাদুর রহমান কিরণ। টঙ্গী ও গাজীপুরের বেশকিছু কারখানার ঝুট ব্যবসায় একক নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। টঙ্গীর চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, অপরাধ সাম্র্র্রাজ্যেও তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিরণের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, পূবাইল এলাকা ছাড়াও আসাদুর রহমান কিরণ ও তার স্ত্রীর নামে নিউইয়র্ক শহরে তিনটি বাড়ি রয়েছে। রয়েছে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডে সাততলা ভবন বাড়ি (১০ নম্বর) এবং ৭ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ১২ তলা নির্মাণাধীন ভবন (৯৫ নম্বর)। ভালুকা উপজেলায় নিজের ও স্ত্রীর নামে ২০০ বিঘা জমির ওপর ফ্যাক্টরি। রাজধানীর গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর রোডে ২৫০০ বর্গফুটের আলিশান ফ্ল্যাট এবং টঙ্গী জোনে তার তিনটি ফ্যাক্টরি রয়েছে। টঙ্গীর পাগাড়ে, আশুলিয়ায় ও গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রীর নামে, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমি রয়েছে। টঙ্গীর পাগাড়ে সংখ্যালঘুদের জমি ও মরকুন কবরস্থানের জায়গা দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রথম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়ে পাচার করা টাকায় তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের লকারে তার ৫০০-৬০০ ভরি সোনা ও হীরা রয়েছে। কিরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক বলে জানা গেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, শোক দিবস ও কর্মকর্তাদের পিকনিকসহ বিভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন না করেই সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন কিরণ। বিশ্ব ইজতেমার পরিচালনা ব্যয় দেখিয়েও তিনি কোটি কোটি টাকা লুটেছেন।