হাজেরা হাসমত ডিগ্রি কলেজ
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া হাজেরা হাসমত ডিগ্রি কলেজের এডহক কমিটির সভাপতি পদে নাম প্রস্তাব না করায় কলেজের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত, শিক্ষক-শিক্ষর্থীকে মারধর ও কলেজের বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে সাবেক এমপি হারুনুর রশিদের অনুসারী নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার পর থেকে কলেজের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে মারধরের শিকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিএনপি নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর দেশের সব কলেজের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল হয়। এরপর গৃদকালিন্দিয়া হাজেরা হাসমত ডিগ্রি কলেজের সভাপতি মনোনীত হন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারা হক। তিনি এর আগেও সভাপতি ছিলেন। এরপর থেকে চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের বিএনপির সাবেক এমপি লায়ন হারুনুর রশিদের অনুসারী নেতাকর্মীরা তাকে সভাপতি মনোনীত করার জন্য প্রস্তাব করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গৌরী রানী সাহার কাছে।
সাবেক এমপিকে সভাপতি হিসেব প্রস্তাব না করায় গত ১৭ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা কলেজ এলাকায় মনাববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। পরে কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে এসে কেন সাবেক এমপিকে সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করা হলো না মর্মে উত্তেজিত হয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত, শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ও শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম জুনায়দকে মারধর ও রক্তাক্ত জখম করে। স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল খানের নেতৃত্বে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী এই হামলা চালায় বলে অভিযোগ। তারা ওই সময় কলেজের সিসিটিটিভ ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে এবং অধ্যক্ষ ও শিক্ষককে কক্ষ থেকে বের করে তালা বদ্ধ করে দেয়।
হামলার সময় সাবেক চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন খান এর নেতৃত্বে লায়ন হারুনুর রশিদের অনুসারী মশিউর রহমান রিপন, আনিছুর রহমান আজাদ, আরিফ হোসেন খান, সাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া, ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী, মাহবুবুর বাশার বিপুল, আনোয়ার হোসেন পাটওয়ারী, নাসির হোসেন ও মফিজুল ইসলামসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
কলেজের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার খাজা মো. মাছুম বলেন, ‘সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল খানের নেতৃত্বে বিএনপি নেতা আজিজুর রহমান, হুমায়ুনসহ অধ্যক্ষের কক্ষে তারা প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সুযোগ দেয়নি। তারা অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনকে মারতে মারতে মেঝেতে ফেলে দেয়। এসময় শিক্ষকরা তাকে উদ্ধার করে। ঘটনার শেষে আমাদের কলেজের প্রাক্তণ ছাত্র জুনায়েদ আসলে তাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সে পরবর্তীতে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়।’
হামলার শিকার শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কোন কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তারা আমাকে মারধর করে। কোন কথা বলার সুযোগ দেয়নি। সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান উপস্থিত থেকে এই ঘটনা ঘটায়। তারা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ড. শামছুল হক ভুঁইয়ার ছবিটিও ভাঙচুর করে।’
হামলায় গুরুতর আহত কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম জুনায়েদ বলেন, ‘আমি জানতে পারি লায়ন হারুনুর রশিদের লোকজন মানববন্ধন করেছে। তখন আমি কলেজে আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছি। আমার ভাই সেখানে চাকরি করে। কলেজ প্রবেশ করে অধ্যক্ষকের কক্ষে গিয়ে দেখি লোকজন শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনকে মারধর করছে। এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যে আমিও হামলার শিকার হই। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে বাড়িতে আছি।’
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গৌরী রানী সাহা বলেন, ‘গত ১৭ নভেম্বর সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে কলেজের সামনে হট্টোগল শুনতে পাই। তাৎক্ষণিক শিক্ষকদেরকে পাঠাই বিষয়টি জানার জন্য। পরে শিক্ষকরা শ্রেণি কক্ষে যান এবং শিক্ষার্থীদের কলেজ থেকে বের হতে দেননি। এই সময়ে বিএনপির সাবেক এমপি লায়ন হারুনুর রশিদ এর অনুসারী বিএনপি নেতাকর্মীরা আমার কক্ষে প্রবেশ করে। তারা আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে এবং শিক্ষক দেলোয়ার ও শিক্ষার্থী জুনয়ায়েদকে মারধর করে। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল খান ও আজিজ চেয়ারম্যান উপস্থিত থেকে এসব ঘটনা ঘটায়।’
তিনি বলেন, ‘তাদের দাবি তাদের নেতাকে সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব পাঠানো। কলেজে একটি কমিটি আছে। পরবর্তীতে নিয়মানুসারে সব কাজ হবে। তারা জোর করে তাৎক্ষনিক তাদের নেতাকে সভাপতি করার জন্য খারাপ আচরণ করে। এই ঘটনার পর তারা অধ্যক্ষের কক্ষে তালা দেয়। এর পরদিন গত ১৮ নভেম্বর সকালে তারা বহিরাগত শিক্ষার্থীদের নিয়ে কলেজে হট্টোগল করে। পরিস্থিতি উত্তেজিত হওয়ায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ উপস্থিত থেকে কলেজের অধ্যক্ষের তালা ভেঙে খুলে দেয়। এরপর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’
অধ্যক্ষ আরো বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা বলেছেন তাদের নেতা হারুনুর রশিদ কলেজের ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন। এমন কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। যদি থাকে তারা উপস্থাপন করতে পারেন। সবকিছুই নিয়মানুসারে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে হবে, হামলা করে নয়। হামলার ঘটনায় গত ১৯ নভেম্বর কলেজের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’
সাবেক এমপি লায়ন হারুনুর রশিদ এর স্থানীয় প্রতিনিধি দাবীদার সাবেক চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন খান বলেন, ‘সাবেক এমপির এই কলেজে অনেক দান-অনুদান আছে। কিন্তু উনাকে গত একদশকে সে হিসেবে সম্মানিত করা হয়নি। গত ৫ আগস্টের পরে আমরা বহুবার কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নিকট উনাকে সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করার জন্য গিয়েছি। তিনি আমাদের কথা কর্ণপাত করেননি এবং ইউএনও আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েও বদলি হয়ে যান। যে কারণে আমরা মানববন্ধন করেছি।’
হামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি চলে আসার পর এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ, হুমায়ুনসহ অনেকেই ছিলেন। আহত জুনায়েদ আমার ভাতিজা। আমি তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে গিয়েছি। শিক্ষককে মারধর এসব ঘটনাগুলো কোনটাই আমি সমর্থন করি না। এসব ঘটনার জন্য আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিকট দু:খ প্রকাশ করবো।’
সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আব্দুল আজিজ বলেন, ‘কলেজের অভিভাবক হিসেবে সেখানে গিয়েছি। সেখানে যাওয়া আমাদের যুক্তিযুক্ত। তবে হামলার ঘটনার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। অধ্যক্ষের কক্ষে আমি আধা ঘন্টা থেকে চলে এসেছি।’
আরেক চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন মুঠোফোনে বলেন, ‘কলেজের ওই ঘটনা সম্পর্কে আমি জানিনা। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে জানার জন্য সাবেক এমপি লায়ন হারুনুর রশিদ এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। কোনটির জবাব না পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এম হাসান