সৈয়দপুরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর গুলির নির্দেশ দাতা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আমিনুল ইসলাম এখনও সৈয়দপুর উপজেলা ভুমি অফিসে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নির্দেশে ছোড়া গুলিতে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত ও অঙ্গহানী ঘটে অনেকের। তারপরেও কোন ওই উর্ধত্বন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যাবস্থা না নেয়ায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শান্তির শহর সৈয়দপুরের সার্বিক পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ ছিল। আন্দোলনকারীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের কর্মসূচী পালন করছিলেন। শহরের প্রাণকেন্দ্র পাঁচমাথা মোড় ও ট্রাফিক পুলিশ বক্স এলাকায় কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা অবস্থান করছিল। ওই সময় ট্রাফিক বক্সে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আমিনুল হকসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সৈয়দপুর সার্কেল) কল্লোল দত্ত, সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) এস এম রাসেল পারভেজসহ রিজার্ভ পুলিশ সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কোন প্রকার আইন পরিপন্থি কর্মসূচী বা কার্যক্রম ছিলনা। বেলা পৌনে ২ টার দিকে ছাত্র জনতা তাদের সেদিনের কর্মসূচী প্রায় শেষ করছিলেন। তবে আকস্মিক শান্ত পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে।
একজন পুলিশ সদস্য শারীরিক দূর্বলতার জন্য হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে পাঠানো নিয়ে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝিতে বিতণ্ডা হয়। কয়েকজন সমন্বয়ক বিষয়টি তাৎক্ষনিক সুরাহা করে অসুস্থ পুলিশ সদস্যকে হাপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। এর কিছু সময় পর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আমিনুল ইসলাম পুলিশকে রেডি হওয়ার নির্দেশ দেন। এতেই পুলিশের কয়েকজন সদস্য আন্দোলনকারীদের উপর এলোপাথারী গুলি বর্ষণ করে। মুহুর্তে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অসংখ্য ছাত্র-জনতা। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পুরো সমাবেশ। সড়কে সড়কে ছড়িয়ে পড়ে লোকজন। আশ্রয় নেয় বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে। চলতে থাকে পুলিশের গুলি। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরেক গ্রুপ পুলিশ আবার শুরু করে গুলিবর্ষণ। এর ফাঁকে ছাত্র-জনতাও শুরু করে ইট-পাথর নিক্ষেপ। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠে। রাস্তায় রাস্তায় আহত গুলিবিদ্ধ মানুষের আহাজারী আর বিক্ষিপ্ত ছাত্র জনতার চিৎকারে প্রকম্পিত হয় চারপাশ। পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুলিশের প্রহরায় ফিল্মি স্টাইলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন এসিল্যান্ড। ক্ষিপ্ত ছাত্র-জনতা চড়াও হলে পুলিশ সদস্যরা ফায়ার করতে করতে পালিয়ে যায় । সৈয়দপুর থানার আরও কিছু পুলিশ কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পুরো শহরের সড়কে অভিযান চালায়। রিজার্ভ পুলিশ সদস্যরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। লোকজন দেখলেই পুলিশ মুহুর্মুহ গুলি বর্ষণ চালায় রনক্ষেত্র পরিনত হয় পুরো শহর। এই অতর্কিত হামলায় ছাত্র-জনতা, পথচারী, দোকানদার, ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুকসহ মোট ১৩৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন গুরুত্বর জখম হয়েছেন আর ৮ জন চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় দৃষ্টি হারিয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বেশ কয়েকজন। এখনও অনেকে চিকিৎসাধীন। এছাড়া ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আহতদের গ্রেফতার করাসহ বাড়ি বাড়ি তল্লাসীর নামে চালানো হয় হামলা ভাঙ্চুর। আটকের পর থানায় চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। এমনকি নখ তুলে নেয়া ও প্রশ্রাব পান করানোর মত ঘটনাও ঘটিয়েছে পুলিশ। ঘটনার সিসি টিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে সংগৃহিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী আটকের ভয় দেখিয়ে করা হয় বাণিজ্য। আর এর নেপথ্যে ছিলেন এসিল্যান্ড আমিনুল ইসলাম। অনেক ক্ষেত্রে অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নিজেই।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সৈয়দপুর সার্কেল) কল্লোল দত্ত, থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাইফুল ইসলাম ও অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) এস এম রাসেল পারভেজ কে বদলী ও ওএসডি করা হয়। কিন্তু পুলিশকে গুলির নির্দেশদাতা এসিল্যান্ড এখনও তার পদে ও একই কর্মস্থলে বহাল রয়েছেন। কেন, কোন খুটির জোরে তিনি এখনও সৈয়দপুরে দায়িত্ব পালন করছেন? কি কারণে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি এর কোন জবাবদিহিতা নেই। এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সৈয়দপুরের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন আহতরা। তারা ওই কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
পুলিশের গুলিতে ডান চোখ হারানো শিক্ষার্থী ও শহরের ১২ নং ওয়াডের নতুন বাবুপাড়া সাদ্দাম মোড় এলাকার রাহিমুল ইসলাম মাহিন এর পিতা মো. ইউসুফ আলী বলেন, স্বৈরাচার সরকারের দোসর ছিলেন সহকারী কশিনার (ভুমি) আমিনুল ইসলাম। তার নির্দেশে এমন অমানবিক ভাবে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এতে আমার ছেলে অন্ধত্ব বরণ করেছে। তাই তার অপসারণ ও শাস্তি দাবি করছি। একই ভাবে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসার অভাবে প্রায় অন্ধত্ব বরন করেছেন পৌর ১০ নং ওয়াডের বাহাতি ক্রিকেটার সাকিব মাহমুদ উল্লাহ (২২) ও উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের দর্জিপাড়ার আলিমুল ইসলাম (৪৫)। তারা বলেন, এসিল্যান্ডের কারণে আমারা চোখের দৃষ্টি হারিয়েছি। তাই উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি।
সৈয়দপুর শহরের গোলাহাট এলাকার বাসিন্দা ও ঢাকা তেজগাঁও কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং সমন্বয়ক শাহরিয়ার রিফাত সরকার বলেন, সেদিনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। তার নির্দেশেই পুলিশ আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অতর্কিত এলোপাথারী গুলি চালিয়েছিল। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা তখন মুহুর্তে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় শত শত মানুষ হাসপাতালে কান্নার রোল পড়েছিল। আজও অনেকে চোখ হারিয়ে এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাই গণহত্যাকারী সরকারের দোসরের দ্রুত অপসারণ ও উপযুক্ত শাস্তি চাই। জানতে চাইলে সৈয়দপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি গুলি করার কোন লিখিত নির্দেশ দেইনি। আমার নির্দেশ ছাড়াই পুলিশ গুলি চালিয়ে খুব খারাপ করেছে। কারণ সেখানে গুলি চালানোর মত কোন পরিস্থিতি ছিলনা। আমি নিজেও গুলির মধ্যে জীবন নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে এসেছি।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক নায়িরুজ্জামন বলেন, আমি নতুন এসেছি। সৈয়দপুরের এসিল্যান্ড কর্তৃক ১৮ জুলাই পুলিশকে গুলির নির্দেশ প্রদানের বিষয়ে আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে তদন্ত পুর্বক সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
রাজু