ব্রিটিশ হাতে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুর ও পার্বতীপুর রেলওয়ে কারখানা এবং সেতু কারখানাপরিদর্শনে যাবেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
এ খবরে রেলওয়ে অঙ্গনসহ সৈয়দপুরবাসীর মাঝে আনন্দের বাতাস বইছে। তাদের প্রত্যাশা , অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টায় এবার দাড়িয়ে যাবে সৈয়ূপুর রেলওয়ে। নেতিয়ে পড়া রেলওয়ে খাতকে নতুন উদ্যমে কর্মচঞ্চল করতে যাবতীয় ব্যবস্থা নেবেন।
দেশের সর্ববৃহৎ রেলওয়ে ও সেতু কারখানা রয়েছে সৈয়দপুরে। বৃটিশদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই দুই কারখানা আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। অযত্নে অবহেলায় চরম বেহাল দশায় নিপতিত হয়তো রেল সেবাখাতের উতপাদন মুলক এই দুই প্রতিষ্ঠান। বিগত সরকারের আমলে রেলের এই দুই কারখানাকে রক্ষায় ধারাবাহিক ভাবে ৫ মন্ত্রী সাড়ে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছে। তবে কেউ কোন পদক্ষােপ নেয়নি। দিনের পর দিন এই দুই কারখানা জনবল সংকটে প্রায় বন্ধের উপক্রম। সাথে অভিভাবকহীনতায় এর কয়েক হাজার কোটি টাকার জমি বেদখল হয়েছে। কেপিআই এলাকা দখলে নিয়ে গড়া হয়েছে স্কুল, রাজনৈতিক দলের অফিস ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। দখল করা হয়েছে রেল ওয়ের বাসাবাড়ি। বিষয়গুলো রেলের সকল কর্মচারী থেকে মন্ত্রী জানলেও উদ্ধারে কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি।
অথচ এটিকে কেন্দ্র করে বেঁচে আছে বাংলাদেশের রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই দেশের অন্যতম প্রধান পরিবহণ খাতকে টিকিয়ে রাখতে রেলওয়ের উন্নয়নে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরী। সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার দাবি উঠেছে। রেলওয়ে কারখানা সূত্রে জানা যায়, সরকার তথা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় লোকবলের চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র ২৬ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে ধুকে ধুকে চলছে কার্যক্রম। প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ না দেয়ায় চাহিদা অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ ও উৎপাদন কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে রেল সেতু কারখানায়। এখানে ৫ শত লোকবলে স্থানে কাজ করছে কেবল ৮ জন। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকা মুল্যের ৬৯ টি মেশিন ও এর ভিতরের মালামাল মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে সুপরিকল্পিতভাবেই এই সংকট সৃষ্টি করে ক্রমে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে রেলওয়ের একটি চক্র। উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্বেও কারখানার সপহুলো অচল করে রাখা হয়েছে। রেললাইন, ব্রিজ, রেল ক্রোসিং, স্টেশন ইয়াড ওভার ব্রিজসহ কোচ, ওয়াগনের সকল যন্ত্রাংশ তৈরীর ব্যবস্থা থাকলেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় নেতাকর্মীদের মোটাতাজা করতে সব ধরণের যন্ত্রপাতি বাইরের ঠিকাদারের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগে সরবরাহের সিস্টেম চালু করা হয়। এতে রেলওয়ে যেমন রাজস্ব হারিয়েছে তেমনি কর্মচারীরা কাজ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে কারখানার ২৬ টি ও সেতু কারখানার ৫ টি সপের (উপ-কারখানা) সংকটে ধুকছে।
দেখা যায়, রেল কারখানার স’মিল সপ দীর্ঘদিন থেকে একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে। এতে ওব সপের অধিকাংশ মেশিন নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দিয়ে অনেক ভালো মেশিনকেও অকেজো দেখিয়ে বিদেশ থেকে নতুন মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। আর এই ক্রয় সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম দলীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে সম্পন্ন করে বিপুল পরিমান অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। আমদানীকৃত মেশিনগুলোও দক্ষ জনবলের অভাবে নষ্ট হওয়ার পথে। এতে করে রেলওয়ের বিশাল অংকের অর্থ অপচয় হয়েছে। একইভাবে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্য করার মাধ্যমে দলের নেতারা উপকৃত হলেও নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা দক্ষ ও যোগ্য না হওয়ায় কারখানার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। আর পুরাতন অভিজ্ঞ লোকজন অবসরে যাওয়ায় মেশিন চালনায় জটিলতার কারণে উৎপাদন ব্যহত হয়েছে। এই অজুহাতে সপগুলোর উৎপাদন বন্ধ রেখে শুধুমাত্র মেরামতের কাজ চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী ভিত্তিতে কয়েকটি কোম্পানীকে চুক্তি করে মেরামতের কাজ দেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানীর সিংহভাগই আওয়ামী ঘরানার। স্থানীয় রেলওয়ে শ্রমিকলীগ নেতার সাথে ওইসব কোম্পানী কর্তৃপক্ষ যোগসাজশে নামকাওয়াস্তে কাজ করে বিশাল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এতেও রেলওয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সৈয়দপুর উপজেলা আমীর হাফেজ মাওলানা আব্দুল মুনতাকিম বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের সময় শ্রমিক নেতা ও কর্মকর্তারা মিলে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা কারখানা তথা রেলওয়ের উন্নয়ন না করে নিজেদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে রেলওয়ের কার্যকর ও স্থায়ী কোন উন্নয়ন হয়নি। বরং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও বাজেট বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করলে টেকসই উন্নয়ন সাধিত হবে। তাই এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার সুদৃষ্টি দিবেন বলেই আমি আশা করি।
সৈয়দপুর রাজনৈতিক জেলা বিএনপি’র সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল গফুর সরকার বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান জানাই যে, শ্রমিক ও কাঁচামাল দিয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাকে সচল করতে হবে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময় কারখানাটিকে লুটপাট করে ধ্বংস করা হয়েছে। টেন্ডার দিয়ে সাবেক ডিএস এবং ডাব্লু এম যন্ত্রাংশ ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দূর্নীতি করেছেন। যার কারণে আজ রেলওয়ে কারখানায় অচলাবস্থা। এসকল অনিয়ম ও দূর্নীতির তদন্ত করে দায়ী কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক (ডিএসডাব্লু) মোস্তফা জাকির হাসান বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই জাতীয় সম্পদটিকে রক্ষায় প্রয়োজন জরুরী ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে চাহিদা মত মালামাল সরবরাহ করা এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনবল নিয়োগ দিয়ে পুরোদমে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা। তাহলে যেমন কারখানার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসবে তেমনি বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রয়োজনীয় গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে, রেল উপদেষ্টার আগমন কে কেন্দ্র করে রেল স্টেশন অবকাঠামো, কারখানার সকল শেড, রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে। সৌন্দর্য বর্ধনে চুনকাম ও রঙের প্রলেপে রাঙানো হচ্ছে সৈয়দপুর রেলের সকল দৃশ্যমান স্থাপনা। যাতে কর্মকর্তাদের আকানো সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে উপদেষ্টা ভাবেন ভালই চলছে সৈয়দপুর রেল। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে উতপাদন খাত।
মহসিন/জাফরান