ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকরা বৃহস্পতিবার মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করার চেষ্টা করলে ছাত্রভঙ্গ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল বন্ধের নির্দেশের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রিক্সাচালকরা। সড়কের পাশাপাশি ট্রেনলাইনও অবরোধ করেন তারা। এতে সারাদেশের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সড়ক অবরোধে পুরো ঢাকা শহর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ভয়াবহ যানজটে নাভিশ্বাস ওঠে নগরবাসীর। পরে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ছয় ঘণ্টা পর বিকেল তিনটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
গত মঙ্গলবার উচ্চ আদালত থেকে ঢাকা মহানগর এলাকায় তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধের নির্দেশ দেন। এরই প্রতিবাদে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে প্রথম দফা রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড়ে আড়াই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে চালকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন আহত হন।
এর পর বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার দিকে দ্বিতীয়দফা ব্যাটারিচালিত রিক্সা-চালকরা রাজধানীর মহাখালী, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, নাখালপাড়া, তেজগাঁও, বনানী, গুলশান, মিরপুর, গাবতলী ও ডেমরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। ফলে এসব এলাকায় ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। সড়কে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে ভারি ও হালকা যানবাহন। এতে শিক্ষার্থী, অফিসগামী মানুষ, নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। রোগীদের হাসপাতালে নিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ট্রেন অবরোধ ॥ পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালকরা মহাখালী রেলক্রসিংয়ে অবস্থান নেন। এরপর থেকে কমলাপুরের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলে ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি জয়নাল আবেদিন জানান। এই এলাকায় রেলক্রসিংয়ের দুইদিকে যান চলাচলও বন্ধ ছিল।
এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, সকাল ১০টা থেকে রেললাইনের ওপর রিক্সা চালকরা অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। নিরাপত্তা ও যাত্রীদের স্বার্থে ওই সময় থেকে ঢাকা থেকে কোনো ট্রেন ছাড়েনি বা আসেনি। বিকেল তিনটার দিকে সেনাবাহিনী রেললাইন থেকে রিক্সা চালকদের সরিয়ে দিলে ছয় ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার জানান, রিক্সা চালকরা সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সকাল নয়টার দিকে মহাখালী রেলগেটে অবস্থান নিয়ে রেলসহ সব ধরনের যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন দেড় থেকে দুই হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালক। এছাড়া তারা মহাখালী মোড়ে জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাদের সরে যেতে বললেও তারা অনড় থাকে। এ সময় মহাখালী, তেজগাঁও, বনানী, গুলশান ও আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সড়কে সব ধরনের যানবাহন দীর্ঘ লাইনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে।
রিক্সাচালকরা মহাখালীতে রেললাইনের ওপর অবস্থান নিলে ঢাকা-টঙ্গী-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সড়ক থেকে তাদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তারা উল্টো পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এ অবস্থায় তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধাওয়া দেন। এতে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-ওদিকে পালিয়ে যান। পরে তারা রেলগেটের পাশের সড়কে অবস্থান নেন। রিক্সাচালকদের কয়েকজন মহাখালী এলাকার একটি শপিংমলে ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অটোরিক্সা চালকরা জানান, আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছেড়ে যাব না। ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধের সিদ্ধান্তে আমাদের পেটে লাথি দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন কী করব? চুরি করব, নাকি ছিনতাই করব। রিক্সা না চালাতে পারলে আমরা কী করে চলব, কীভাবে টাকা আয় করব। তাই পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী যত চেষ্টাই করুক না কেন, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছেড়ে যাব না।
বিক্ষোভকারীরা জানান, আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিনা উস্কানিতে আমাদের লাঠিপেটা করে। আমরা তো আমাদের পেটের দায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। তাহলে কেন বিনা কারণে আমাদের এভাবে মারা হলো।
আন্দোলনরত রিক্সাচালক ওয়াজেদ জানান, আমার পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী আমি। আমি রিক্সা চালিয়ে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেই। এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এতে আমার ও আমাদের ভাইদের পেটে লাথি মারা হয়েছে। রিক্সা চালাতে না পেরে আমরা অন্ধকার দেখছি। কীভাবে সংসার চালাব, সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছি।
সূত্র জানায়, প্রথমে ফার্মগেট থেকে উত্তরা ও গুলশানগামী লেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় উন্মুক্ত করা হয়। এরপর বাকি লেনগুলো দিয়েও যান চলাচল শুরু হয়।
জানা গেছে, মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা অটোরিক্সা চালকদের ধাওয়া দেয় সেনাবাহিনী। জবাবে আন্দোলনকারীরাও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সতর্ক অবস্থার কারণে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়নি। সেনাদের ধাওয়ায় রিক্সাচালকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যান। পরে সেখানে বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্য অবস্থান নেন। এরপর থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
সকাল নয়টার দিকে ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকরা মিরপুর মাজার রোড, দারুস সালাম, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকার সড়কে অবস্থান নেন। এতে এলাকায় ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। ডিএমপির মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার সারজিনা নাসরিন জানান, বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিতে দিতে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে যায়।
এদিকে সকাল ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরে তিন রাস্তার মোড় অবরোধ করেন রিক্সাচালকরা। ফলে ওই এলাকাও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
একইচিত্র ছিল মিরপুর, গাবতলী ও ডেমরা এলাকাতে। ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকদের সড়ক অবরোধে তীব্র যানজট তৈরি হয়। এতে দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ।
কল্যাণপুর নতুনবাজার এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার মিলি জানান, সকালে ডাক্তার দেখানোর জন্য বের হয়েছিলাম। পান্থপথ বিআরবি হাসপাতালে যেতে তিন ঘণ্টা লেগেছে। অথচ সেখানে যেতে আধাঘণ্টা সময় লাগে। অবরোধের কারণে বেশ কয়েকটি মোড়ে আটকে পড়তে হয়েছে। একই অভিজ্ঞতার কথা জানান অনেক যানবাহনের যাত্রী ও সাধারণ মানুষ। অনেকে যানবাহনে যাওয়ার আশা বাদ দিয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেন।
একই ধরনের চিত্র দেখা যায় মাজার রোড, দারুস সালাম, টেকনিক্যাল, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকাতেও।
এছাড়া বৃহস্পতিবার সকালে আগারগাঁও, নাখালপাড়া এলাকার সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন রিক্সাচালকরা। এতে সেসব এলাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবির খান জানান, সকাল থেকে মোহাম্মদপুর তিনরাস্তার মোড়, শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁও এবং নাখালপাড়া এলাকায় সড়ক বন্ধ করে দেয় রিক্সাচালকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে দুপুরে সড়ক থেকে চালকরা সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। মিরপুর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকরা বিভিন্ন সড়কে মিছিল করেন বলে জানিয়েছেন মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাকছেদুর রহমান।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর ১৩ নম্বর থেকে মিছিল বের করেন অটোরিক্সা চালকরা। এরপর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গিয়ে তারা সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলেও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন। মিরপুর ১২ নম্বরের দিক থেকে আরেকটি মিছিল নিয়ে রিক্সাচালকরা সেখানকার সড়কে বসার চেষ্টা করলেও সেনাবাহিনী, পুলিশ তাদের দাঁড়াতে দেয়নি। এরপর চালকরা মেট্রোরেল স্টেশনের নিচের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেন। সকালে খিলগাঁও এলাকায় সড়ক অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চালকরা।
সূত্র জানায়, মঙ্গলবার উচ্চ আদালত থেকে ঢাকা মহানগর এলাকায় তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্যাডেলচালিত রিক্সা সমিতির করা একটি রিটের প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, ব্যাটারিচালিত রিক্সার লাইসেন্স নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এটা পুরোপুরি অবৈধ।
রিক্সা, ব্যাটারি রিক্সাভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বুধবার এক বিবৃতিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
এর আগে গত মে মাসে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত কোনো রিক্সা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিদ্যুৎচালিত তিন চাকার যানগুলো অটো, ইজিবাইকসহ নানা নামে পরিচিত। দুর্ঘটনার জন্য সড়কে মোটরবাইক এবং ইজিবাইকের চলাচলকে দায়ী করেন তিনি। সে সময় ঢাকার সাবেক দুই মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং আতিকুল ইসলামও শহরের মধ্যে এসব ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়ে তাদের সম্মতি জানিয়েছিলেন। পরে ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় সড়ক অবরোধ করেন চালক ও গ্যারেজ মালিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চালকদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
পরে জীবিকার বিষয়টি বিবেচনায় এনে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল করতে পারবে বলে ঘোষণা দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার পতনের পর গত আগস্টে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল বন্ধসহ কয়েকটি দাবিতে সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেন প্যাডেলচালিত রিক্সাচালকরা।
রিক্সা চালকদের দাবি, ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল বন্ধের পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মতো উত্তরেও রিক্সার নতুন লাইসেন্স দিতে হবে, পুরনো লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।