উত্তরবঙ্গের নীলফামারী ও লালমনিরহাটে খেটে খাওয়া শ্রমিকরা মৌসুমের এই সময়টায় রাতে সারিগান এবং মনসামঙ্গল গীতের আসর বসায়
নানান রঙের শতরঞ্জি/হরেক রকম গান/লোকশিল্প, লোকনৃত্য/বাহের দ্যাশের প্রাণ। বাহের দ্যাশ বলতে দেশের সর্ব উত্তরের আট জেলা রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়কে বোঝানো হয়েছে। ভাওয়াইয়া ভাটিয়ারি ও লোকগীতিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক গান লোকসংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ।
বাংলার নদীতে একা একা নৌকা বাইতে বাইতে উদাস মাঝি গেয়ে ওঠেন ভাটিয়ালি গান। আর যখন অনেক মাঝি একসঙ্গে দাঁড় টানেন, বৈঠার তালে তালে সমবেত কণ্ঠে তারা আরেক রকমের গান ধরে থাকেন। চাষের কাজে বীজ বোনা, হাল দেওয়া, ফসল নিড়ানো, কাটা এবং তোলার সময়ে, কিংবা মাটি কোপানো, গাছ কাটার মতো যে কোনো কায়িক পরিশ্রমের সময়েও সারি গান করেন। গ্রাম বাংলায় বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী লোকেরা সবাই মিলে গাইতে গাইতে কঠোর পরিশ্রমের কাজগুলো হাসি মুখে করে ফেলেন।
রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে রঞ্জন যে খোদাই-নৃত্যের কথা বলেছিল, সেটাও তাই। সারি গানের মধ্যে এক ব্যক্তির চেয়ে যৌথ জীবন সংগ্রামের কথাই বেশি করে ফুটে ওঠে। গানের নাম কেন এমন হলো, তা নিয়ে অনেক রকম মত রয়েছে। সারিবদ্ধভাবে গাওয়া হয় বলে এর নাম সারি গান। অন্যদিকে সারি কথাটির মানে শ্রেণি। একই শ্রেণির মানুষ একই কাজ করতে করতে গেয়ে ওঠেন এই গান।
বাংলার গ্রামীণ সমাজে খুব প্রাচীন কাল থেকেই সারি গান প্রচলিত ছিল। মনসামঙ্গল কাব্যধারার সব থেকে জনপ্রিয় কবি ছিলেন বিজয়গুপ্ত। ১৫ শতকের শেষ দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। এই কবির লেখা পদ্মপুরাণ-এ সারি গানের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে সংগীত অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে সারি কথাটি। মুঘল নৌবাহিনীতে যে নৌকা চালানোর প্রতিযোগিতা হতো, তার অনুসরণে বাংলায় নৌকাবাইচ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। নৌকাবাইচের হাত ধরে বাংলার নানা প্রান্তে সারি গানের প্রসার ঘটে।
নীলফামারীর কুন্দপুকুর এলাকায় সারিবদ্ধভাবে নারী কায়িক শ্রমিকদের কাজের সময় এক সঙ্গে সারি গান গাইতে শোনা যায়। নারী শ্রমিক কল্পনা রানী (৩০) বলেন, আমরা সারিবদ্ধভাবে ফসলের জমিতে কাজ করার সময় সারি গান গাই। এই গান গাইলে কর্মশক্তি বেড়ে যায় আমাদের।
এদিকে এক যুগ আগেও রংপুর অঞ্চলে মনসামঙ্গল গীতের রমরমা অবস্থা ছিল। এই গীতের শিল্পীদের ছিল সন্তোষজনক কদর। সারা বছরই ছিল তাদের ডাক। এখন কদাচিৎ আয়োজন হয় মনসামঙ্গলের আসর। এই আসরটি ধরে রেখেছে লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপ্টানা রায়পাড়া গ্রামবাসী।
মনসামঙ্গল শিল্পীরা জানান, সাপের দেবী মনসাকে খুশি রাখতে মনসামঙ্গল গীতের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অনেকে মনসা দেবীর কাছে মানত করে মনের ইচ্ছা পূরণ করায় মনসামঙ্গল গীত আয়োজন করেন। প্রতিটি মনসামঙ্গল গীতের আসরে ১২-১৫ শিল্পী অংশ নেন। তাদের মধ্যে থাকে মূল গিদাল (গায়ক), ৬-৭ জন থাকেন সহশিল্পী, একজন কৌতুক অভিনেতা ও অন্যরা থাকেন বাদ্যযন্ত্র শিল্পী হিসেবে। মনসামঙ্গল গীতের আসরে মনসা দেবীকে আরাধনা ছাড়াও এ আসরে থাকে কৌতুক, বিয়ের গীত, ভাওয়াইয়া ও খনার বচন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মনসামঙ্গল গীতে পুরুষেরা নারী সেজে নেচে-গেয়ে বিনোদন দিয়ে থাকেন।
নারী-পুরুষ সবাই বিমোহিত হয়ে রাত জেগে মনসামঙ্গল গীত উপভোগ করেন। লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী গ্রামের পলব চন্দ্র রায় (৪৭) জানান, ‘আমাদের সংস্কৃতি অনেক বদলে গেছে’ ‘নেহাত প্রয়োজন ছাড়া মনসামঙ্গল গীত আয়োজন করা হয় না।’ রংপুরের মনসামঙ্গল শিল্পী সুধান চন্দ্র রায় (৩৭) বলেন, ‘প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে মনসামঙ্গল গীতের সঙ্গে যুক্ত। নারী সেজে নেচে-গেয়ে দর্শকদের আনন্দ দিই। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা মজুরি পাই। ‘মনসামঙ্গল গীতের সঙ্গে এতই নিবিড়ভাবে জড়িত যে তা ছাড়তে পারছি না,’ মন্তব্য করেন তিনি।
রামচরণ রায় (৩৭) বলেন, ‘এটা ভাবতে খুব কষ্ট হয়, মনসামঙ্গল গীত হারিয়ে যাচ্ছে। পরিচিত অনেক শিল্পী এ পেশা ছেড়ে দিনমজুরি করছেন। আমাদের পেশাকে টিকিয়ে রাখতে কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করছেন না।’ তার আশঙ্কা, ‘আগামী কয়েক বছর পর মনসামঙ্গল গীতের কোনো শিল্পী খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ লোকগীতি গবেষক অধীন চন্দ্র বৈরাগী (৭৭) বলেন, ‘কোথাও মনসামঙ্গল গীত হচ্ছে জানলে ছুটে যাই। অনেক মানুষ এখনো রাত জেগে মনসামঙ্গল গীত উপভোগ করেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যবাহী গীত বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে।