শহীদ গোলাম নাফিজের ছবিতে মায়ের স্মৃতিচারন
শহীদ নাফিজের মায়ের এখন একমাত্র শেষ স্মৃতি রিক্সার পাদানিতে ঝুলে থাকা নাফিজের শেষ ছবি।
বারবার যেন এখানেই খুঁজে বেড়ান ছেলেকে। মনে হয় হয়তো এখনি এসে ঘরে ঢুকবে ছেলে। মায়ের মন এখনও মানতেই চায় না তার ছেলে আর নেই।
বাংলাদেশে সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকশত মানুষ৷ নিহতদের মধ্যে অনেক শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক রয়েছেন৷ তাদেরই একজন শহীদ গোলাম নাফিজ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফার্মগেটের পথচারী-সেতুর নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী গোলাম নাফিজ। গুলিবিদ্ধ নাফিজকে পুলিশ যখন রিকশার পাদানিতে তুলে দেয়, তখনো সে রিকশার রডটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। যে ছবিটি কাঁদিয়ে ছিল পুরো বাংলাদেশকে।
“বেঁচে থাকলে আরও দুইটা গুলি কর।” গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে ড্রেন থেকে রিকশায় তোলার সময় বলছিলেন এক পুলিশ সদস্য। মুমূর্ষু নাফিজকে পাশের হাসপাতালে নেয়া হলে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। চিকিৎসা পেলে হয়তো প্রাণে বাঁচতো, সেই আফসোসে দগ্ধ হচ্ছে নাফিজের পরিবার।
নাফিজ নয় যেন রিকশার পাদানিতে ঝুলছে এক টুকরো বাংলাদেশ। ১৭ বছরের নাফিজের বুলেটবিদ্ধ দেহ, রক্ত ঝরে ঝরে নিথর হলেও মাথা থেকে খসে পড়েনি বাংলাদেশের পতাকা।
সেদিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে নাফিজের বাবা রহমান বলেন, ‘‘চার আগস্ট সকাল এগারোটার দিকে আমার ছেলে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে রওয়ান দিয়েছিল৷ শুরুতে সে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত গেছে৷ শাহবাগ মোড় থেকে ব্যাক করে আবার ফার্মগেটে এসেছে৷ পরে তিনটার সময় ওর মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে৷ তখন সে বলেছিল যে, আম্মু আমি আন্দোলনে এসেছি৷ তোমাদের কী অবস্থা? তখন তার মা বলেন যে, বাবা, ভালো আছি৷ তার মা তাকে বাসায় চলে আসতে বলেন৷ সে-ও আসবে জানায়৷''
কিন্তু তারপর আর ছেলের কোনো খোঁজ পাননি গোলাম রহমান৷ দিন গড়িয়ে রাত অবধি বিভিন্ন থানায় ঘুরেছেন তিনি৷ রহমান বলেন, ‘‘রাত বারোটার দিকে আমার আরেক ছেলে মানবজমিনে প্রকাশিত একটি ছবি দেখতে পায়৷ সেই ছবি দেখে নিশ্চিত হই যে, আমার ছেলে আর জীবিত নেই, মারা গেছে৷
রাত সাড়ে তিনটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি আমার ছেলের লাশ সেখানে আছে৷ মাথার মধ্যে একটা পতাকা বাঁধা৷ সেদিন সকালে সে আমাকে বলেছিল আব্বু আমাকে বিশটা টাকা দেও৷ তখন আমার কাছে ১৩০ টাকা ছিল৷ আমি বলেছিলাম একশো টাকা নেও৷ সে বলেছে না, ত্রিশ টাকা দেও৷ ত্রিশ টাকা দিছি৷ সেই ত্রিশ টাকা দিয়ে সে একটা পতাকা কিনে মাথার মধ্যে বেঁধে রেখেছিল,'' যোগ করেন তিনি৷
রহমান বলেন, ‘‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, যেভাবে ওর শরীরে আঘাত করেছে, নাকে, মুখে, মাথায়, পায়ে৷ মনে করেন, এমন অবস্থায় আঘাত করেছে, আঘাতের পর আঘাত, আঘাতের পর আঘাত৷ এত আঘাত করেছে বলাবাহুল্য৷ একটা ছেলেকে একটা বাড়ি দিলেই যথেষ্ট৷ ওরা তো নিষ্পাপ৷ ১৬ বছরের ছেলে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তাকে এমনভাবে মারধর করেছে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার, খুব খারাপ অবস্থা৷ এরপর আবার বুকের মধ্যে গুলি করেছে৷ গুলিটা শরীর ছেদ করে বেরিয়ে যায়৷ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করা হয়েছিল বলে একজন ডক্টর জানিয়েছেন৷''
নাফিজের মা নাজমা আক্তার বলেন, ‘ও ছোট থেকেই পতাকা খুব ভালোবাসতো। সবসময় স্বপ্ন ছিল দেশ নিয়ে। এ পতাকাগুলো আমি চাইতাম যে আর রাখার দরকার নেই। ও ফেলতে দিত না। কাল দেখি পতাকাগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা।’
তিনি বলেন, ‘ইদানিং ও বলতো পরিবর্তন যদি না আসে মা, তাহলে আপনার নাফিজ না, কারো বেঁচে থেকে লাভ নেই। পরিবর্তন আনতেই হবে, নাহলে আমরা ঘরের ভেতরে বন্দি।’
ইসরাত