ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কলাপাড়ায় বোম্বাই মরিচের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ

মেজবাহউদ্দিন মাননু

প্রকাশিত: ১১:০০, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

কলাপাড়ায় বোম্বাই মরিচের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ

বোম্বাই মরিচ ভোজনপ্রিয় মানুষের নিত্যদিনের খাবারের সঙ্গে একটি লোভনীয় সংযোজন। খেতে বসে খাবার প্লেটের কোণে বোম্বাই মরিচ নিয়ে বসতে দেখা যায় বহুজনকে।

কাঁচাবাজারের নানা ফিরিস্তির সঙ্গে লিখিত না থাকলেও গৃহিনী বলে দেন গৃহকর্তাকে এই শোন, পারলে বোম্বাই মরিচ দিও। বোম্বাই মরিচ দিয়ে শাক ভাজা, তরকারি কিংবা পাতলা ডাল রান্না; এ অঞ্চলের মানুষের কাছে খুবই মজার খাবার। সুস্বাদু খাবারের সঙ্গেও বোম্বাই মরিচের সংযোজন থাকে। পারিবারিক পরিসরে খাবার টেবিলে খেতে বসে বোম্বাই মরিচটি ঘুরে বেড়ায় এক হাত থেকে অন্যের হাতে। যেন সকলের হাত বাড়ানো থাকে মরিচটির দিকে। বোম্বাই মরিচ মানুষের খাবারে সখের সংযোজন। বাড়ি-ঘরের পাশে, পিড়ায় দু’চারটি বোম্বাই মরিচের গাছ এ কারণে প্রত্যেক বাড়িতেই দেখা যায়। কিন্তু বোম্বাই মরিচও যে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় তা খুব কম দেখা যায়। 


লঙ্কা কিংবা মরিচের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় আমাদের দেশে লঙ্কা এনেছে পর্তুগীজরা। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলের আগে ভারতে লঙ্কার ব্যবহার ছিল না। লঙ্কা বা ঝালের কাজটি চলত গোলমরিচ, পিপ্পলী ও আদা দিয়ে। পর্তুগীজরা পশ্চিম ব্রাজিল থেকে লঙ্কা নিয়ে আসে গোয়ায়- সেখান থেকেই লঙ্কার যাত্রা শুরু। বিশ্বে প্রায় ১৬শ’ জাতের লঙ্কা আছে। বোম্বাই লঙ্কা বা বোম্বাই মরিচ এদেরই একটি।


এখন পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাণিজ্যিকভাবেই চাষ হচ্ছে বোম্বাই মরিচের। শধু বাণিজ্যিকভাবেই বোম্বাই মরিচের আবাদ নয়। বোম্বাই মরিচের আবাদ করে জীবিকার চাঁকা সচল করছেন এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। এদের একজন জাকির হোসেন, বাড়ি কলাপাড়ার কুমিরমারা গ্রামে। তিনি জানান, এবছর সাড়ে ১০ শতক জমিতে বোম্বাই মরিচের আবাদ করেছেন। সাত বছর ধরে বোম্বাই মরিচের আবাদ করছেন। ক্ষেত তৈরি করতে প্রথম বছর শেড করতে কিছু টাকার পুঁজির দরকার হয়। লোহার কিংবা বাঁশের স্ট্রাকচারের ওপর পলিথিন আর জাল দিয়েছেন। ওই টাকা উঠে গেছে বলে জানালেন এই সফল মরিচ চাষী। এখন ফি বছর ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। এ বছর মোট পাঁচ শতাধিক গাছ লাগিয়েছেন। বছরে অন্তত ছয় মাস ফলন পেয়ে থাকেন। গতকাল শনিবারও ৩০০ মরিচ বিক্রি করেছেন। একইভাবে আনোয়ার সরদার ২২ শ’, মো. সোহেল ৩৫ শ’, মাসুম চৌধুরী ৪৫ শ, জসিম মৃধা ২৯ শ’ মরিচ পাইকারি বিক্রি করেছেন। ঢাকার পাইকাররা একেকটি মরিচ তিন থেকে সাড়ে তিন  টাকা দরে ক্ষেত থেকে কিনে নেয় বলে জানালেন চাষীরা। কুমিরমারা গ্রামের অন্তত ৫৬ জন চাষী বোম্বাই মরিচের আবাদ করেছেন। গড়ে দুই থেকে ২০ শতক জমিতে একেকজনে ক্ষেত করেছেন। শতকে গড়ে ৫০ হাজার থেকে কমপক্ষে এক লাখ টাকা লাভ করে থাকেন চাষীরা। 


দু’টি জাতের বোম্বাই মরিচের আবাদ করেন এসব কৃষক। দেশি আর ঘৃত বোম্বাই মরিচ। এসব ঢাকা ছাড়াও বরিশাল, বরগুনা. পটুয়াখালী চালান হয়। কৃষকরা জানান, কুমিরমারা গ্রাম ছাড়াও নীলগঞ্জের আরও পাঁচটি গ্রামের বোম্বাইসহ বিভিন্ন মরিচের আবাদ চলে আসছে। সবাই জানালেন ঝড়-বৃষ্টি থেকে গাছ রক্ষায় প্রথমে ক্ষেত তৈরিতে একটু বেশি পুঁজি লাগে। এসব চাষীদের কোন ব্যাংক ঋণ না পাওয়ার ক্ষোভ রয়েছে। অনেক শিক্ষিত যুবকরাও বোম্বাই মরিচের আবাদে নেমেছেন।
শুধু বোম্বাই মরিচ নয়। বোম্বাই মরিচের চারা বিক্রি করে জীবিকার চাকা সচল রেখেছেন নুর জামাল খান। জামাল জানালেন, প্রায় দুই যুগ ধরে বিভিন্ন হাট-বাজারের মতো ফি মঙ্গলবারে কলাপাড়ায় বোম্বাই মরিচের চারা বিক্রি করছেন। এ বছর অন্তত তিন হাজার ঝাঁকা (ডালায়) চারা করেছেন। একেকটি ঝাঁকায় ৫০/৬০টি চারা করেছেন। জানালেন জামাল, ঘৃত বোম্বাই, কালা বোম্বাই, সাদা বোম্বাই ছাড়াও কালো খাঁড়া মরিচের চারাও করেন নার্সারিতে। ভাদ্র মাস থেকে শুরু করেন নার্সারি। মাটি তৈরি করেন প্রথমে। তার সঙ্গে মেশানো হয় পাথর চুনা। কেঁচো ও উইসহ বিভিন্ন পোকা দমনে মেশান এক ধরনের কীটনাশক। ডালা কিনে মাটি দিয়ে মাটির সঙ্গে ছাই মেশানো হয়। সঙ্গে কিছু গোবর সার। পাঁকা বোম্বাই মরিচ কিনতে হয় বীজের জন্য। বীজ রোপনের পরে মাচান দিতে হয় বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য। আশ্বিনের শেষদিকে বিক্রি শুরু করেন। ফি বছর এ চাষীর ২০০ মন গোবর সার সংগ্রহে প্রায় তিন হাজার, ওষুধ কিনতে প্রায় সাত হাজার, ছাই ২০০ ডালা প্রায় এক হাজার টাকা ব্যয় হয়। ডালা কিনতে ব্যয় হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যা তো আছেই। প্রায় কুড়ি হাজার টাকা ব্যয় হয় ফি-মৌসুমে এমন দাবি জামাল খানের। একেকটি ডালা ভর্তি চারা বিক্রি করেন ৭০-৮০ টাকায়। ফি বছর ৪০ থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। এভাবে কলাপাড়ায় অন্তত কোটি টাকার বোম্বাই মরিচের আবাদ হয় বলে কৃষকের দাবি। অন্তত আড়াই শ’ চাষী আবাদ করেন বোম্বাই মরিচের।
তবে জামাল খানের কষ্ট হাট-বাজারে খাঁজনার রেট অনেক বেড়ে গেছে। নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। রাস্তায় বসেন চারার ডালি নিয়ে। পাঁচ শ’ টাকা খাঁজনা দিতে হয় প্রতি হাটে। এছাড়া যার দোকানের সামনে বসেন তাকে আরও দুশ’ টাকা দিতে হয়। এলাকার দারিদ্র্য বিমোচনে দৃষ্টান্ত হওয়া এসব পরিবার এখন স্বল্প পুঁজির প্রয়োজন। নইলে ছন্দপতন ঘটার শঙ্কা রয়েছে বোম্বাই মরিচের আবাদে। অথচ পরিবারটির কারণে অনেকেই বোম্বাই মরিচের আবাদে নেমেছেন।


কলাপাড়া উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে কলাপাড়ায় বিভিন্ন ধরনের মরিচের আবাদ হয় মোট ১২৭৪ হেক্টর জমিতে। তবে বোম্বাই মরিচ আবাদের আলাদা কোন তথ্য জানা যায়নি।

জাফরান

×