রাসমেলা
সব ভক্তের দৃষ্টি পুব আকাশে। যেন অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন। সাগরের বুক চিরে সূর্যের লাল আভা উঁকি দেওয়ার আগেই হাজার হাজার রাসভক্ত নর-নারী জড়ো হন কুয়াকাটা সৈকতের বেলাভূমে। উলুধ্বনিতে সরগম গোটা সৈকত। রাসভক্ত পুণ্যার্থীরা কেউ পূঁজা করছেন। কেউবা পূণ্যস্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শনিবার ভোরের আলো না ফুটতেই পরিপূর্ণ হয়ে যায় পূণ্যার্থীর মিলনমেলায়। হাজার হাজার ভক্তের যেন মিলন মেলা বসে। রাসভক্তদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। এবছরও শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ রাস উৎসবে ভক্তদের যেন ঢল নামে। ফি বছরের মতো সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী হাজার হাজার নর-নারী সারা বছরের পঙ্কিলতা দূর করেন সাগরে পূণ্যস্নানে মধ্য দিয়ে। কেউ বা করেন এখান পানি সংগ্রহ। আসেন জাগতিক পাপ মোচনের আশায়।
রাসলীলার এই পূণ্যস্নানে অংশ নিতে গত বৃস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই রাসভক্তদের কুয়াকাটায় আগমন শুরু হয়। শুক্রবার সন্ধ্যার পরে কুয়াকাটায় রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে সমবেত হন হাজার হাজার রাসভক্ত পূণ্যার্থী। রাত জেগে তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। কেউ বা আবার রাস মেলায় প্রিয়জনের জন্য করেন কেনাকাটা। মধ্যরাতেই সাগরে পূণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে সেখানকার অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি হয়। রাসভক্ত অনেকে জানালেন রোগ শোক থেকে মুক্তির আশায় তাঁরা সপরিবারে পূণ্যস্নানে এসেছেন। কেউ বাসে, কেউবা অটো কিংবা ইজি বাইক নিয়ে এসেছেন রাস উৎসবে। এবছর রাসমেলার উদ্বোধন করেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন। এসময় কলাপাড়ার ইউএনও রবিউল ইসলামসহ গণ্যমান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এবারে রাসকে ঘিরে কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন ও কুয়াকাটা পৌরসভার উদ্যোগে বিশেষ সাংস্কুতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ভক্ত অনিতা রাণী জানান, তিনি এ নিয়ে ১৪ বার পূণ্যস্নানে কুয়াকাটায় আসেন। তার বিশ্বাস এখানে পূণ্যস্নানে তার সকল মনের বাসনা পুরন হয়। সারা বছরের পাপ মোচনের আশায় সে এবছরও স্বপরিবারে এসেছেন। মধাব-সাগরী দম্পতি জানান, ফি বছরের মতো পূণ্যের আশায় সাগরে পূণ্যস্নানে তারাও স্বপরিবারে এসছেন। এদের বিশ্বাস সারা বছরের পঙ্কিলতা দূর হবে পূণ্যস্নানসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে। রাস উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নিহার রঞ্জন বলেন‘ শুক্রবার পূজার আনুষ্ঠানিকতার রাতভর চলে নামকীর্তন। ভগবৎপাঠ ও আরতি। শ্রীকৃষ্ণের লীলা কীর্তনে অংশ নেন ভক্তরা। তিনি বলেন, এবছর গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে রাস উৎসব। শনিবার সূর্যোদয়ের আগেই সাগরে পাপ মোচনের জন্য পূণ্যস্নান সারবেন ভক্তরা। শুক্রবার দিনভর মানত, পূজা দিয়েছেন পুরোহিত এনে। শুধু হিন্দু নয় এ উৎসবে মিলিত হন নানা ধর্মের মানুষ। উপভোগ করেন অনুষ্ঠান। ভক্ত সৌমিত্র জানান, সারা বছর এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করি। এবারও তাই ছুটে এসেছেন। মোটকথা কুয়াকাটায় এখন রাসভক্তের যেন ঢল নেমেছিল।
রাসভক্তরা আজ শনিবার বিকেল থেকে উপজেলা সদর কলাপাড়ার মদনমোহন সেবাশ্রমে ধর্মীয় উৎসবে মিলিত হবেন। সেবাশ্রমে স্থাপন করা রাধাকৃষ্ণের ১৭ জোড়া যুগল প্রতিমা দর্শন ছাড়াও ধর্মীয় উৎসব পালন করবেন আগতরা। সেবাশ্রম অঙ্গনে ব্যাপক পরিসরে দোকানপাট বসেছে। এখানে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনের রাসমেলা। হিন্দু সম্প্রদায়ের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী রাস পুর্ণিমার উৎসবকে ঘিরে কলাপাড়া-কুয়াকাটায় ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাণ ফিরে পায় ব্যবসায়ীরা। হোটেল-মোটেল থেকে সকল দোকানপাটে থাকে ক্রেতার উপচেপড়া ভিড়। রাস পূর্ণিমার তিথিতে কুয়াকাটায় বঙ্গোপসাগরে পূণ্যস্নানে আসা পূণ্যার্থীদের জন্য সকল ধরনের নিরাপত্তার প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, রাস পুর্ণিমা উপলক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। জেলা-উপজেলা ও পৌরপ্রশাসনের সমন্বয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ পাঁচ শতাধিক সদস্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। মন্দির এলাকা সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আগত রাসভক্তদের জন্য বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থার জন্য অস্থায়ী লেট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। পূণ্যার্থীর নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলসহ হালকা যানবাহন নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিংএর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মোটরসাইকেল, টমটম, অটোরিক্সায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে মনিটরিংএর ব্যবস্থা রয়েছে। আগতদের জরুরি স্বাস্থ্য সেবার জন্য থাকছে মেডিকেল টিম। রাসভক্ত নারীরা পূণ্যস্নান শেষে যেন শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পরিবর্তন করতে পারেন এজন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়। ব্যবস্থা রয়েছে সুপেয় পানির। পূণ্যস্নানের সময় সকল ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্ধারকারী দল রাখা হয়েছে। কুয়াকাটা সৈকত পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
রাসপুঁজা উদযাপন কমিটির আয়োজকরা জানান, ঐতিহ্যবাহী এ রাস পূর্ণিমার উৎসব পূণ্যস্নান ও ধর্মীয় রীতি পালনে বরাবরের মতো এবছরও ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে রাসপূজা উৎযাপন কমিটি এবং কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন। হিন্দু সনাতন ধর্মের অনুসারিদের বিশ্বাসমতে শতবছরের এ পূণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে সারা বছররের পঙ্কিলতা দূর করেন। নতুন দিনের যাত্রা শুরু করবেন তাঁরা। ফি বছরের মতো এসময় ভরা পূর্ণিমার তিথিতে হাজার হাজার রাসভক্ত কুয়াকাটায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিলিত হন। করেন সাগরে পূণ্যস্নান। আজ বিকেল থেকে কলাপাড়া পৌরশহরের মদন মোহন সেবাশ্রমে মিলিত হন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। দর্শন করবেন রাধাকৃষ্ণের যুগল প্রতিমা। রাস উৎসবকে ঘিরে ভক্তদের যেন ঢল নামে। যেন কোন বাধা আটকাতে পারেনি রাসভক্তদের।
আর কে