পাহাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে হস্তশিল্প কোমর তাঁত। আর এখানকার পাহাড়িরা যুগ-যুগান্তর ধরে নিজেরাই শীতের কম্বল, চাদর ও ব্যবহার্য বিভিন্ন বস্ত্র সামগ্রী তৈরি করে আসছেন। কিন্তু ব্যাপক চাহিদার পরও উল-সুতার দাম বৃদ্ধি এবং বাজারজাত সমস্যার কারণে ক্রমেই নারীদের তৈরি উলের কম্বলসহ নানা প্রকারের ব্যবহার্য উপকরণ হারিয়ে যাচ্ছে। তবে, স্থানীয়দের আগ্রহের অভাবসহ নানা কারণেই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে পাহাড়িদের কোমর তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটছে না বলে মনে করেন বিসিকের কর্মকর্তারা।
লুপ্তপ্রায় কোমর তাঁতের ব্যাপারে আগ্রহী একজন উপজাতীয় শিক্ষিকা প্রতিভা ত্রিপুরা। তিনি দায়িত্বের ফাঁকে ফাঁকে ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত শিল্প ধরে রাখার জন্য কাজ করে থাকেন। শুধু তাই নয়, বাজার থেকে উল সুতা কিনে এনে ঘরে বসে কম্বল, চাদরসহ বিভিন্ন বস্ত্র সামগ্রী তৈরি করছেন। বাজারে বিক্রি করে লাভের চেয়ে এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখাই তার মূল লক্ষ্য বলে জানালেন।
শিক্ষিকা প্রতিভা ত্রিপুরার অনুভূতিজুড়ে ঐতিহ্য ও আর সংস্কৃতি। এখানো শীতের কম্বলসহ সবকিছুই নিজে তৈরি করে ব্যবহার করছেন। তিনি জানান, ‘স্কুল জীবন হতেই মা করুনা ত্রিপুরা হাতে ধরে এসব কাজ শিখান। মায়ের কথা ভুলে যাইনি। মা বলেছিলেন, নিজেদের স্বতন্ত্র ঐহিত্য যেন হারিয়ে না যায়, খেয়াল রাখতে। প্রত্যেককেই মা-দাদিদের দেখানো কাজ ধরে রাখা উচিত।’ সেজন্যই প্রতিভা ত্রিপুরা বলেন, ‘মায়ের কাছ থেকেই কাজ শিখেছিলাম। মায়ের শেখানো কাজ এখনো করছি। ’
প্রতিভা জানালেন, বর্তমান বাজারে উপজাতীয়দের হাতে তৈরি একটি শীতের কম্বল বিক্রি করা যায় ৪-৮শ’ টাকা পর্যন্ত। এমন একটি কম্বল তৈরিতে উল কিনতে হয় প্রায় সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকার। এছাড়া উল কিনে মার দেওয়া, টানা দেওয়া, শুকানো এবং বুননে যে সময়, শ্রম এবং মেধা দিতে হয়, তাতে পারিশ্রমিক উঠে আসে না। উল সুতার সহজলভ্যতা, বাজারে বিক্রির নিশ্চয়তাসহ সহজ প্রযুক্তির ব্যবহার করা গেলে খাগড়াছড়ির উপজাতীয়দের পাশাপাশি সব জাতিগোষ্ঠীর নারীরাই উপকৃত হতে পারে। নারীদের তৈরি কম্বলসহ কোমর তাঁত শিল্পের বিষয়ে উপজাতীয়দের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। বিশিষ্ট নারীনেত্রী ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সেফালিকা ত্রিপুরা জানান, যতই পড়ালেখা শিখছে ততই ভুলছে নিজের ঐতিহ্যগাঁথা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিখর ভুলে যাওয়া ঠিক নয়, তাতে ভবিষ্যৎও ভালো হয় না। তিনি পৃষ্টপোষকতা বাড়িয়ে কোমর তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন।
সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তা সুপ্তা চাকমার মতে, গ্রামীণ নারীরা আজও নিজেদের মমতায় আঁকড়ে রেখেছেন কোমর তাঁতকে। প্রতিটি উপজাতীয় পল্লীতে প্রতিটি ঘরেই কমবেশি শিল্পটি বেঁচে আছে আপন গতিতে। কিন্তু শহুরে উপজাতীয়রা অনেটাই ভুলতে বসেছে প্রাচীন নিজস্বতাকে। তবে, স্বীকার করে নিলেন বহুরূপি সমস্যা আর সীমাবদ্ধতাকে। উল, সুতার অতিরিক্ত মূল্য, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত সংকট, সর্বোপরি পৃষ্টপোষকতার অভাবই এখানে এ শিল্পটি দিনকে দিন বিলুপ্ত হবার আশঙ্কার অন্যতম কারণ।
মা-দাদিদের রেখে যাওয়া কোমর তাঁতকে রক্ষায় নিজেদেরকেই উদ্যোগী হবার ওপর জোর দিয়েছেন বয়স্ক উপজাতীয় নারীরা। দীঘিনালার করুনা ত্রিপুরা জানান, ‘বর্তমান প্রজন্মের নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। নিজের ঐতিহ্য নিজেকেই টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায় একদিন সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’ তিনি নতুনদেরকে আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজনবোধে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিকের) খাগড়াছড়ির কর্মকর্তারা খাগড়াছড়িতে উপজাতীয়দের কোমর তাঁত শিল্পের প্রতি অনাগ্রহের নেপথ্যে স্থানীয় জনগণের অসচেতনতা, চিন্তার অদূরদর্শিতা এবং কাঁচামালের অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, খাগড়াছড়ির তুলনায় রাঙামাটির অবস্থা বেশ ভালো। সেখানকার কয়েকজন নারী পথ প্রদর্শকের কারণেই মূলত, তারা যতটা এগিয়েছে, ততটাই পিছিয়েছে খাগড়াছড়ি। তবে, সরকারের দুটি প্রকল্প দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ থাকায় খুবই ক্ষতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন তারা।
বিসিকের খাগড়াছড়ির উপ-ব্যবস্থাপক আলী আর রাজী বলেন, ‘বিশেষত, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বহু আদিবাসী নারীকে উল-সুতা ও তাঁত সহায়তা দেওয়া হতো। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিসিক কিনে এনে তা ১০ শতাংশ লাভে বিক্রি করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েকবছর ধরে প্রকল্পটি বন্ধ থাকায় সামান্য সহায়তাও দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া বিসিকের আশির দশকে চালু হওয়া সিআর আইডিপি (মূল প্রকল্প)টি মাঝ পথেই অচল হওয়ায় প্রশিক্ষণসহ অনেক সরকারি সহায়তাই এখন আর নেই।
পাহাড়ে নারীদের শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হস্তশিল্পকে ধরে রাখার ওপর তাগাদা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যথায় কম্বলসহ কোমর তাঁতের ঐহিত্য হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তারা।
