পরিবেশবান্ধব ঘর ও আবহাওয়ায় গতানুগতিকতার বাইরে খোলামেলা পরিবেশসহ বিদ্যালয়টির ব্যতিক্রমী পাঠদান প্রান্তিক শিশুদের করেছে স্কুলমুখী। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার নজরকারা স্থাপত্য শৈলীতে সাড়া ফেলেছে পাবনার শিশুদের স্কুল বড়াল বিদ্যানিকেতন। নান্দনিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ত স্থাপত্যনকশার জন্য সম্প্রতি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের পুরস্কার জিতেছে প্রত্যন্ত গ্রামের এ স্কুলটি।
সরজমিনে দেখা যায়, পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদরে বড়াল নদী পাড়ের একটি গ্রাম কুমারগাড়া। দখল দূষণে মৃতপ্রায় ঐতিহ্যবাহী বড়াল নদী। বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিশুদের পরিবেশ সচেতন করতে ২০১৯ সালে নিজ পরিবারের জমি ও অর্থায়নে বড়াল বিদ্যানিকেতন নামের স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন সমাজসেবী দম্পতি এস এম মিজানুর রহমান ও দিল আফরোজা। পরিবেশ রক্ষায় এমন প্রচেষ্টায় মুগ্ধ হয়ে সাথে যুক্ত হন পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব।
পরিবেশবান্ধব স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এস এম মিজানুর রহমান বলেন, বড়াল রক্ষায় নেমে আমার কাছে মনে হলো এভাবে শুধু নদী রক্ষা করলেই চলবে না। এলাকার মানুষের চরমভাবে শিক্ষার প্রতি অনীহা, বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায় না, অভিভাবকেরাও পাঠাতে আগ্রহ পান না। এর কারণ আমার কাছে মনে হলো, গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা ও এর পরিবেশ তাদের শিক্ষার দিকে টানে না। তাই এই প্রান্তিক পর্যায়ে টিনের চালা দিয়ে স্কুলটির যাত্রা শুরু করি। পরে আমার শ্যালিকা শাহনাজ বেগম ও স্থপতি ইকবাল হাবিব সাহেব আমার পাশে দাঁড়ান। বর্তমানে ইট, কাঠ, বাঁশ ও মাটি দিয়ে পরিবেশবান্ধব তৈরী স্কুলটি। এর মধ্য দিয়েই আজকের বড়াল বিদ্যানিকেতন।
স্কুলটির স্থাপত্যনকশাকার স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, পরিবেশ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চাটমোহর গিয়েছিলাম। পরবিবেশ আন্দোলনের সহকর্মী মিজানুর রহমান প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন জেনে সেটি পরিদর্শন করি। সেখানে দেখি গরমে টিনের ঘরে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন, প্রচন্ড সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিক্ষক ও স্কুল সংশ্লিষ্টদের প্রচেষ্টার ত্রুটি নেই। এই জায়গা থেকেই আমি স্কুলটি সাথে থাকার চেষ্টা করি। একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্যনকশায় স্কুলটি বড় উদাহরণ করার চিন্তাভাবনার জায়গা থেকে আজকের এই রুপ দেই। খুব বেশি যে ব্যয় পড়েছে তা নয়, আসলে স্বদিচ্ছা থাকলে সীমিত ব্যয়েও নজরকাড়া স্থাপত্য ও পরিবেশ তৈরি করা যায়। এই বিদ্যালয়টি তার উদাহরণ। সবশেষ স্থাপত্য নকশায় এটি আন্তর্জাতিক দুটি পুরস্কার অর্জন করে। সরকারি স্কুলগুলো যে পরিমাণ ব্যয়ে গড়া হয়, তার চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম ব্যয়েও এগুলো করা সম্ভব বলেও জানান এই স্থপতি।
বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা যায়, প্রকৃতি ও শিশুশিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে ইকবাল হাবিবের নজরকাড়া নকশায় খোল নলচে বদলে নান্দনিক স্থাপত্যে রূপ নেয় বড়াল বিদ্যানিকেতন। ইট, কাঠ, বাঁশ ও মাটির তৈরী স্কুলটিতে রয়েছে দুটি একতলা ও একটি দোতলা ভবন। শান্তিনিকেতনের আদলে উঠোনে তিনটি আমগাছ। ইটের গাঁথুনি ও দেয়ালের নকশায় রয়েছে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশের ব্যবস্থা। শ্রেণীকক্ষ থেকেই রোদ, বৃষ্টি উপভোগের সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আরো আছে গুপ্তধনের রহস্যময় গুহার মতো মাটির তৈরী আকর্ষণীয় এক লাইব্রেরীও। শৈশব থেকেই শিশুদের প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার ভাবনা থেকেই এমন প্রচেষ্টা উদ্যোক্তাদের। শিক্ষার্থীরাও ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে নিয়মিত স্কুলে আসেন।
কথা হয় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিথীর সাথে, আগে স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না তার। এখন স্কুলে না যেতে পারলে ভালো লাগে না। স্কুলে আসলেই মন ভালো হয়ে যায়। তীব্র গরমেও আমাদের গরম অনুভব হয় না। এখানে প্রচুর গাছপালা, আমরা মজা করে সময় কাটাই। আবার ক্লাসরুমও খুব সুন্দর।
পঞ্চম শ্রেণীর ঝিনুক খাতুন বলে, এতো সুন্দর পরিবেশ কোত্থাও নেই। স্কুলে আসলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। তাছাড়া শিক্ষকরা আমাদের অন্যদের মত করে পড়ান না, আদরে, হাসি খেলার মধ্য দিয়ে লেখা পড়া শেখান। এজন্য আমাদের কাছে পড়াশোনা বা স্কুল বিরক্তিকর মনে হয় না। এগুলো আমাদের অন্য বন্ধুরা শুনে আমাদের স্কুলে দেখতেও আসে।
ঝিনুক আরো বলে, আমরা এখানে নাচ, গান ও কবিতা আবৃত্তি সহ সংস্কৃতিমূলক অনেক কিছুই শিখি। জ্ঞানচর্চার জন্য ক্লাসের ফাঁকে নানারকম বই পড়ার জন্য সুন্দর লাইব্রেরী আছে। আমরা বই পড়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ পাই। যেগুলো অন্য স্কুলে সম্ভব না।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, সৃজনশীল স্থাপত্যশৈলীর বিদ্যালয়টিতে শিশুদের পড়ানো হয় হেসে খেলে ও সুরের তালে। শেখানো হয় নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও বিতর্ক। আছে কম্পিউটার ল্যাব। সাজানো বাগানে, হাসি-গানে প্রতিটি শিশুকে মানুষ করে তোলার অঙ্গীকার শিক্ষকদের।
বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক নামজুল সাকিব তন্ময়। তিনি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি নিয়ে স্নাতক করেছেন। ঢাকার একটি বায়িং হাউজে উচ্চপদে চাকরি করতেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেও প্রচেষ্টা দেখে নামমাত্র সম্মানি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক হিসেবে পাঠদান শুরু করেন। তিনি বলেন, রেজাল্টের মোহ থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের দূরে রেখে সঠিক শিক্ষাটা দিতে চাই। ভালো রেজাল্টের অসুস্থ্য প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের দেখতে চাই না। আমরা ওদের নীতিবান আসল মানুষ হিসেবে দেখতে চাই।
পাঠদানের ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, আনন্দের জায়গায় ওদের যে দুর্বলতা সেটিই আমরা কাজে লাগাই। সৌন্দর্য ও আনন্দের আমেজে ওরা পড়াশোনা করে। ক্লাস শেষে ওদের জিজ্ঞেস করি কি শিখলে, ওরা তখন সব শেখাগুলো বলে না। নতুন যেটা শিখেছে সেটিই বলে এবং সেই জায়গাতেই ওদের এতো আগ্রহ। ওরা উন্মুখ হয়ে থাকে, কাল স্কুলে গেলেই আবার ভারী বোঝার মত নয়, মজার ছলে নতুন কিছু শিখতে পারবো। এই আগ্রহটাই আমাদের আপাতত সফলতা।
স্কুল শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার মিঠু বলেন, ক্লাসরুমে বসে ওরা আকাশ দেখছে, বৃষ্টি দেখছে, ছুতে পারছে। ক্লাসরুম সেভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। ফুল পাখি আর সবুজের সাথে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে ওরা। আমার ধারণা, এসব সুযোগ সুবিধা এই প্রজন্মকে করবে উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও মানবিক গুণ সম্পন্ন।
স্কুলের গান ও নাচের শিক্ষিকা প্রজ্ঞা বলেন, আমরা ওদের দেশাত্মবোধক গান ও ছোটদের নাচ শেখাই। ক্লাসিক ধাচের নাচও শেখানো হয়। মূলত বাঙালি সংস্কৃতির সাথে যেগুলো সম্পর্কিত সেসবই শেখানো হয়। সংস্কৃতির মাধ্যমে তারা যেনো নিজেদের সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে এমনটাই উদ্দেশ্য আমাদের।
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দিল আফরোজ জানান, স্কুলটি এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, চাইলেও এখানে বাণিজ্যিকভাবে এই প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। এখানকার প্রত্যেকটি মানুষ প্রতিনিয়ত দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে বাঁচে। তাছাড়া বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনা থেকে এটি করিও নাই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গতানুগতিক ধারার বাইরে এক ভিন্ন শিক্ষা দিতে আমরা এখানকার ছেলে মেয়েদের দায়িত্ব নিয়েছি। এখানে অল্পকিছু টাকা মাসিক ফি হিসেবে নেয়া হয়। এর মধ্যে এদের টিফিন সহ নানা ব্যবস্থা রয়েছে। ওদের আমরা আরো ভালো মানের সেবাটা দিতে চাই, বছরে অন্তত পাঁচজন মানুষ এখান থেকে বের করতে চাই। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের এই সাফল্য আগামীর জন্য বড় উদাহরণ হিসেবে আমরা রেখে যেতে চাই।