ছয় বছর আগেও ছিলেন মোবাইল ও কম্পিউটার মিস্ত্রি। টানাপড়েনের সংসারে অভাব ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। অনলাইন জুয়ার বরকতে কম সময়ের মধ্যে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। রয়েছে একাধিক সুপার শপ। জমি-জমাসহ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বাড়ি। নিয়মিত ঘুরতে যান বিশে^র দেশে। তার এই অবৈধ উপার্জন কাগজপত্রের ফাঁক ফোকড়ে বৈধ আয় হিসেবে দেখাচ্ছেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম মাহমুদুল হাসান। তবে ‘ক্যাসিনো মাসুম’ নামে খুবই পরিচিত তিনি। জেলার মেলান্দহ উপজেলার আদিপৈত গ্রামের আনছারুল আলমের সন্তান মাসুমের বয়স প্রায় ৩৯। অনলাইন জুয়ার কাণ্ডারি হওয়ায় পরিবারের স্বজনদের সাথেও যোগাযোগ খুবই রাখেন মাসুম। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০২ সালে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন মাসুম। এরপর মেলান্দহ বাজারের চিশতীয়া মার্কেট মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখেন এবং বেশ কয়েকজনকে এই কাজ শেখান তিনি। তখন খুব টানাপড়েনের সংসার ছিল তার। ২০১৬ সালের শেষের দিকে রাজশাহীতে একটি দোকানে এক বছর চাকরি করেন তিনি। সেখান থেকে এসে মেলান্দহের জাহানারা লতিফ মহিলা কলেজে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে অস্থায়ী চাকরি করেন দুই বছর। এর মাঝে মেলান্দহের জিন্নাহ মার্কেটের নিচতলায় দোকান ও জামালপুর শহরের শহীদ হারুন সড়কে একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান দেন মাসুম। ২০১৮ সালে আবারও মেলান্দহে ফিরে জিন্নাহ মার্কেটে দোকান নেন তিনি। সেই দোকানে শতকরা ২০ টাকা হারে বসান জুয়ার আসর। সেখান থেকেই জুয়ার দুনিয়ায় প্রবেশ মাসুমের। জিন্নাহ মার্কেটের আড্ডা ক্যাফেতে আইপিএল, বিপিএল ও বিগ ব্যাস খেলার জুয়ার আসরে থাকতো মেলান্দহের কিশোর-তরুণ ও মধ্য বয়সী ছেলেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিন্নাহ মার্কেটের এক দোকানদার বলেন, এই মার্কেটের নিচতলায় মাসুম রাত দিন জুয়া চালাতেন। দোকানে অনেক লোকজন থাকতো। বিষয়টি কানাকানি হলে মাসুম ছাদে একটি ক্যাফে দেন। সেটার আড়ালে তিনি রমরমা জুয়া চালাতেন। তখন জুয়ার বোর্ড থেকে শতকরা বিশ টাকা হারে নিতেন। এভাবে তিনি দিনে হাজার হাজার টাকা আয় করতেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাসুমের সাথে জুয়া খেলায় অংশগ্রহণকারী একজন বলেন, মাসুম ভাইয়ের স্ত্রী যদি বাসা থেকে বাজার পর্যন্ত রিকশা দিয়ে আসতো। সেই রিকশা ভাড়ার বিশ টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা মাঝে মধ্যে মাসুম ভাইয়ের ছিল না। তবে ক্রিকেট লীগের জুয়া থেকে তিনি টাকা ইনকাম শুরু করেন। এভাবেই অনলাইন জুয়ার দিকে আকৃষ্ট হন মাসুম ভাই। আইটি বিষয়ে তিনি অনেক অভিজ্ঞ ছিলেন। নিজে একটি রোবট বানিয়েছিলেন। সেই সময় নিজেই বাংলায় জুয়ার একটি অ্যাপস বানান। অ্যাপসটির নাম ছিল ঢাকা সেল। সেই সময় বাংলায় জুয়ার অ্যাপস মানে বিশাল ব্যাপার। আমরা সেটিতে খেলতাম। মাসুম ভাই ২০১৯ সালে দেশের বাইরে বা দেশের ভেতরেই কোথায় যেন গিয়ে সেই অ্যাপসটি আপডেট করতে অনেক টাকা খরচ করেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তিনি বেশ কয়েকটি অ্যাপসের সুপার এজেন্ট। ২০১৯ সালেই জামালপুরের মেলান্দহের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ক্যাসিনো মাসুমের নাম। নিজের অ্যাপসের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জুয়ার অ্যাপসের সুপার এজেন্ট হয়ে যান ক্যাসিনো মাসুম। আয় করেন কোটি কোটি টাকা। ২০১৯ সালে যখন সারা দেশে ক্যাসিনো কাণ্ডের সাথে জড়িতরা গ্রেপ্তার হতে থাকে। তখন অক্টোবর মাসের শেষের দিকে র্যাব-১৪ এর হাতে চারজনসহ আটক হন মাসুম। তবে সেই মামলায় খালাস পেয়ে যান মাসুমসহ বাকিরা। এরপর একবার র্যাব-১ এর হাতে ধরা পড়লে সেখান থেকেও বের হয়ে যান আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। মাসুমের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, মাসুমের মোবাইলে এমন একটি অ্যাপস আছে যেটিতে এক ক্লিক করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলের সব ডাটা রিমুভ হয়ে যাবে। মাসুম যতবার বিপদে পড়েছে বা কোনো বিপদের সংকেত পেয়েছে। তখনই তার মোবাইলের সব ডাটা রিমুভ করে ফেলেছে। মাসুমের যত সম্পদ : কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও খুব স্বাভাবিক চলাফেরা করেন মাসুম। তার এতদিনের আয়ের কিছু অংশ থেকে শুরু করেছেন বিনিয়োগ। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মাসুম তার অবৈধ আয় থেকে ২০২০ সালে মেলান্দহের ব্র্যাক মোড়ে কিনেছেন দুই বিঘা জমি। যেখানে রয়েছে তার মিশাল এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। এছাড়াও সেখানে রয়েছে সুইমিংপুল, মাশমির জিমসহ অনেক কিছু। জামালপুর-মেলান্দহ সড়কের শিমুলতলা এলাকায় বড় একটি জমি রয়েছে মাসুমের। এর কিছু অংশে রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস। বাকি অংশে মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন তিনি। যার দাম কোটি টাকার ওপরে। এছাড়াও জামালপুর শহরের পশ্চিম নয়াপাড়া এলাকায় একজন চিকিৎসকের বাসা কেনার কথা রয়েছে তার। যেটির দামও কোটি টাকার উপরে। ঢাকার বসুন্ধরাতে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে মাশমির বাজার নামে সুপার শপ দিয়েছিলেন মাসুম। বর্তমানে সেই ব্যবসাটি বাদ দিয়েছেন তিনি। তবে জামালপুর শহরের শহীদ হারুন সড়ক ও মেলান্দহ পৌর এলাকার জিন্নাহ মার্কেটে মাশমির বাজার নামে দুইটি সুপার শপ রয়েছে তার। খবর নিয়ে জানা গেছে, এই দুই সুপার শপ লোকসানে চললেও সেখানে লাভ দেখাচ্ছেন মাসুম। এছাড়াও দামি গাড়িতে চলাফেরা করেন তিনি। মেলান্দহের ফুলছিন্না এলাকায় জমি কিনেছেন ৯৫ শতাংশ। জিন্নাহ মার্কেটের পেছনে হাজি কলোনিতে মাসুমের বাবার নামে থাকা দুতলা বাড়িটির নির্মাণ কাজ করেছেন খুবই বিলাসবহুলভাবে। তবে মাসুমের মতো সৌভাগ্যবান নয় বেশিরভাগ মানুষ। এই অনলাইন জুয়ার কারণে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার বাসিন্দা মো. ময়না (ছদ্মনাম) বলেন, এই অনলাইন জুয়ার লোভে পড়ে আমার সব হারিয়েছি। এখন আমার কোম্পানির চাকরি করতে হয়। প্রথমে দুই একবার জিতে আমি ১৫-২০ হাজার লাভ করি। এরপর হার-জিত লেগেই থাকে। এভাবে খেলতে খেলতে এখন আমার সব শেষ। টানা ছয় মাসে দোকানপাট সব গেছে। আবার এর জন্য প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। অনলাইন জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের ২৭ মার্চ প্রাণ হারাতে হয় উজ্জ্বলকে। জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার বালিয়া ব্রিজপাড়া এলাকায় বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার পাঁচদিন পর পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয় উজ্জ্বলের মরদেহ। নিহত উজ্জ্বলের বাবা উশর আলী বলেন, অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই। তবে এই অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের ধরতে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো কথা বলতে রাজি হননি স্থানীয় প্রশাসনের কেউ। এসব বিষয়ে মোবাইল ফোনে মাসুম বলেন, আমি ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে শুধু ঘুরতে গিয়েছি। সেখানে আমার কোন ব্যবসা নেই। জামালপুর শহরের চিকিৎসকের বাসা আমি কিনি নাই। সেটা এখনও ওই চিকিৎসকের নামেই আছে। ফাইলে এখন বাসা কেনার টাকা দেখানোর মতো টাকা নাই। যেভাবেই হোক একটা সময়তো আয় করেছি। এসব তো হুটহাট করে রেজিস্ট্রি করা সম্ভব না। রেজিস্ট্রি করতে গেলে আইনগত সমস্যায় পড়তে হবে। এই জন্য আমি এই জিনিসগুলো খুব সেন্সিটিভভাবে মেইনটেইন করি। যাতে দুনিয়া উল্টে গেলেও কেউ আমার সম্পদ অবৈধ ঘোষণা করতে না পারে। জামালপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, মাসুমের মতো জামালপুরে এমন অনেকে আছে। যারা অনলাইনের জুয়ার ওপর ভর করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আবার অনেকে নি:স্ব হয়েছেন। দুদকের উচিত হবে এসব ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা। তাহলে অনেকেই বেঁচে যাবে এই অনলাইন জুয়ার থাবা থেকে।