ছবি: সুখী বেগম
স্রোতে ভাসা দলছুট কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে সুখী বেগমের এখন ঠাঁই হয়েছে মহল্লাপাড়ায়। ছিলেন রাবনাবাদ পাড়ের ভাঙ্গা বাঁধের স্লোপে, চৌধুরীপাড়ায়। নেই গ্রামটির জনপদ। সব গিলে খেয়েছে রাবনাবাদ নদী।
এখন রাবনাবাদপাড়ে সরকারের যতোসব উন্নয়ন। হয়েছে পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মান। কিন্তু সুখী বেগম কোন কূল-কিনার পায়নি। পারেনি কোমর সোজা করে দাঁড়াতে। হঠাৎ খুঁজে পাওয়া। ১৪ বছর পরে।রাবনাবাদ পাড়ের শেষ জমিটুকুন সিডরের তান্ডবে ঘরসহ বিলীন। হয় আশ্রয় বাঁধের স্লোপের একটি ঝুপড়িতে। তাও আরেক জলোচ্ছ্বাস আইলা বিধ্বস্ত করে দেয়। তখনকার দুরবস্থায় থাকা সুখী বেগমের জীবনচিত্র উঠে আসে জনকন্ঠের প্যানেল রিপোর্টে।
বিধ্বস্ত বাঁধের স্লোপে চরের শাক রান্না করছিলেন। অন্যের দেয়া অন্নের যোগানে চলছিল দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি। এরপরে আর দেখা মেলেনি এই মানুষটির। ১৪ বছর পরে ফের হঠাৎ দেখা মেলে সুখীর সঙ্গে। পাল্টেছে কলাপাড়ার লালুয়ায় গোটা জনপদ। পথঘাট, প্রশস্থ পাকা সড়ক হয়েছে অনেকটা। বিদ্যুতের আলো পৌছেছে ঘরে ঘরে। পায়রা পোর্টের প্রথম টার্মিণালের কাজ শেষের পথে। চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি। উন্নয়ন চলছে দ্রুতালয়ে। কিন্তু তিন দফা বাড়িঘর পাল্টে সুখী বেগমের পাঁচ জনের সংসারে আরও এক কন্যা মিথিলা এসেছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়েছে। এখন সে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুলের মাসিক অন্তত এক হাজার টাকার খরচের যোগান দিতে না পারায় মাদ্রাসায় ভর্তি করেছেন। আর একমাত্র ছেলে সুহাদ বিয়ে করেছে। নাতিও এসেছে ছেলে বউর কোলজুড়ে। উন্নতি যা এইটুকু। সংসারের মানুষ বেড়েছে। বাড়েনি স্বামী দুলাল গাজীর আয়। রাবনাবাদ পাড় থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দুরে মহল্লাপাড়ায় এক চিলতে জমিতে বাড়ি করেছেন। জানালেন, গৃহহীন হয়ে ঢাকায় গিয়ে ইট-পাথর ভাঙ্গার কাজ করেছেন। রক্ত পানি করা সংগৃহীত টাকায় এই জমিটুকুন কিনেছেন। একটি ঘর করেছেন। তাও এখন জীর্ণদশায়। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। মেরামত প্রয়োজন। কিন্তু সঙ্গতি নেই।
সুখী বেগমের জীবন-সংসারের শ্রী বাড়েনি। তেমনি মেলেনি আর্থিক নিরাপত্তা। কিন্তু দৈন্য বেড়েছে। সংসারের হাল বইয়ে চলা এই গৃহিনী জীবনের সুখ কী বোঝেননি। প্রায় ৩১ বছরের সংসার জীবনের কোন হিসাব মেলাতে পারছেন না। এখন সুখী বেগম প্রায় অচল। বয়সের ভারে নয়, অসুখে। চিকিৎসার যোগানও চলছে না। ‘৭৯ সালে জন্ম নেয়া গ্রামীণ এই নারী ৪৫ বছরেই চলনশক্তি নেই। জীবনশক্তিও হারাতে চলেছে। দুই দফা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছেন ঘরে। জ¦রে আক্রান্ত স্বামী-সন্তানদের ধরা হাতের সহায়তায় উঠে বসতে, চলতে হয়। জানালেন, কিডনিতেও সমস্যা রয়েছে। সপ্তাহে এক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। বললেন হতাশা আর না পাওয়ার অনেক কথা। তা যেন সুখীর দুঃখের সাতকাহন।
স্বামী দুলাল গাজী জানান, ভাগে ট্রলারের কাজে ছিলেন। লোকসানে বাদ দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকার ধার-দেনায় ছেলেকে নিয়ে ছোট্ট ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সাগরে যান। আগে রাবনাবাদে মাছ ধরতেন। পোর্ট হওয়ায় রাবনাবাদ চ্যনেল থেকে দুরে, সাগরবক্ষে যেতে হয়্ অবরোধের পরে ইলিশ নেই। দুই-চার কেজি পোমা মাছ পেলে তাই ভরসা। স্ত্রীর অসুখে নেই অন্তত আড়াই লাখ টাকা। ধার-দেনায় কাহিল। বাবার জমি-জিরেত আরও এক যুগ আগে রাবনাবাদ নদী গিলে খেয়েছে। যদিও বড় মেয়ে লিজা ও মেজ রিণিকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে সুহাদ গাজীকে নিয়ে সংসারের চাকা ঠেলছেন। কিন্তু গতি নেই। এতোসব অসহায়ত্ব, তার ওপরে ছোট্ট মেয়ে মিথিলার লেখাপড়া, এতোসবের যোগান নিয়ে সুখী বেগমের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তিন বেলা স্বামী-সন্তান, নাতি নিয়ে খাবার যোগাড়ের দুর্ভাবনায় কাটে একেকটি প্রহর।
২০০৯ সালের দেখা সুখী বেগমকে যেন এখন মনে হয় অচেনা। প্রকৃতির রোষাণলে পিষ্ট হয়ে চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থার হাল। নদী গিলেছে ঘরবাড়িসহ ঠিকানা। নতুন ঠিকানা একটা জুটেছে। কিন্তু এখন শরীর তাকে কোন ভরসা দেয় না চলনে। একটুতেই চোখে সব ঝাপসা দেখেন। বললেন, চুবান খাইছি সিডরে। ভাসছি আইলায়। দেখছি নার্গিস, বিজলীসহ অনেক দূর্যোগ আর বইন্যা। এহন সামনে পথের দিশা পাই না।’ এ নারীর এখন সবচেয়ে বড় দূর্যোগ আর্থিক অনটন। তাইলে অন্তত চিকিৎসাটা করতে পারতেন। এক রাশ হতাশার রাজ্যে সুখীর যেন দুঃখী মুখখানা অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে বেড়ায়। সুখের স্পর্শ পেয়েছেন এমন কোন ক্ষণের কথা জানাতে পারলেন না এই নারী। তবুও নাম তার সুখী বেগম।
মেজবাহ/ জাফরান