ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

উচ্চ প্রযুক্তির সাম্রাজ্য সিলিকন ভ্যালি

প্রকাশিত: ২১:০২, ১২ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২১:০৯, ১২ নভেম্বর ২০২৪

উচ্চ প্রযুক্তির সাম্রাজ্য সিলিকন ভ্যালি

.

তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে জগৎজোড়া নাম রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির। পৃথিবীর তাবড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ঠিকানা এই শহর। এটি ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণ সানফ্রান্সিসকো বে এলাকায় অবস্থিত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের একটি বিশ্বব্যাপী কেন্দ্র। মাইক্রোপ্রসেসরে ব্যবহৃত হয় সিলিকন ট্রানজিস্টরের সঙ্গে এই অঞ্চলের সম্পর্ক থাকার কারণে ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে নামটি প্রথম গৃহীত হয়েছিল। বর্তমানে সিলিকন ভ্যালিতে কয়েক ডজন প্রধান প্রযুক্তি, সফ্টওয়্যার এবং ইন্টারনেট কোম্পানি রয়েছে। অঞ্চলটি উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্ফ্রান্সিস্কো এবং সান্হোজে শহর দুটির মাঝামাঝি প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। প্রায় ২৫ বছর আগে কম্পিউটার প্রযুক্তির যখন ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়, তখন সিলিকন ভ্যালি হয়ে ওঠে ইন্টারনেট অর্থনীতি এবং উচ্চ প্রযুক্তির বাণিজ্যিক কেন্দ্র। পরবর্তীতে ইয়াহু, গুগল, অ্যাপল, ফেসবুকসহ বড় ইন্টারনেট প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো গড়ে ওঠে এখানে। বর্তমানে বিশ্বের সিংহভাগ কম্পিউটার ও প্রযুক্তি পণ্য সিলিকন ভ্যালি থেকেই উদ্ভাবিত হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তি সফটওয়্যার মাইক্রোচিপস বা ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানকারী প্রায় সকল বৃহৎ প্রতিষ্ঠানেরই এখানে কার্যালয় রয়েছে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি এলাকা রয়েছে যেমনÑ পলো আল্ট্রো, কোপাটিনো, মেনলো পার্ক, মাউন্টেন ভিউ ইত্যাদি। পলো আল্ট্রোতে রয়েছে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি। মেনলো পার্কে রয়েছে ফেসবুক এবং অ্যাপলের অফিস, আর মাউন্টেন ভিউতে রয়েছে গুগলের অফিস। সিলিকন ভ্যালিতে জন্ম নেওয়া হাই-প্রোফাইল উদ্যোগের সংখ্যা এই অঞ্চলটিকে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় লক্ষ্যে পরিণত করেছে। এখানে গড়ে ওঠা প্রায় ৪০০০ উচ্চ প্রযুক্তির   কোম্পানিগুলো প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করছে এবং এর সিংহভাগ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত বিনিয়োগের মাধ্যমে। এর মধ্যে মোট ৪০টি ‘ফরচুন ৫০০’ কোম্পানি রয়েছে। অন্যান্য কোম্পানি হলোÑ গুগল, ইয়াহু, অ্যাডোবি সিস্টেমস, অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসেস, অ্যাপল কম্পিউটার, হিউলেট প্যাকার্ড কোম্পানি, ইন্টেল করপোরেশন, ইবে, এনভিডিয়া, ওরাকল করপোরেশন, সিমেটেক, সান মাইক্রোসিস্টেম্স, আসুস, ফেসবুক, ম্যাকফি, অপেরা সফটওয়্যার, সিমেন্স ইত্যাদি।
মানসম্মত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সিলিকন ভ্যালির আদলে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বেশকিছু দেশ জায়গা টেক হাব বা ‘সিলিকন ভ্যালির বিকল্প’ হওয়ার চেষ্টা করছে। উদীয়মান প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : ১. শেনজেন, চীন : উৎপাদনের জন্য পরিচিত। শেনজেন দ্রুত একটি প্রযুক্তি কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে, বিশেষ করে হার্ডওয়্যার এবং ইলেকট্রনিক্সে। ২. তেল আবিব, ইজরায়েল : প্রায়ই ‘সিলিকন ওয়াদি’ বলা হয়। তেল আবিবের একটি সমৃদ্ধ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম রয়েছে, বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে। ৩. বেঙ্গালুরু, ভারত : প্রায়ই ‘ভারতের সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, এটি সফ্টওয়্যার বিকাশ এবং আইটি পরিষেবাগুলোর জন্য একটি বিশিষ্ট প্রযুক্তি কেন্দ্র। ৪. বার্লিন, জার্মানি : প্রযুক্তি, বায়োটেক এবং সৃজনশীল শিল্পের ওপর ফোকাসসহ বার্লিন তার ক্রমবর্ধমান স্টার্টআপ দৃশ্যের জন্য পরিচিত। ৫. লন্ডন, যুক্তরাজ্য : লন্ডনে ফিনটেক, এআই এবং সাইবার নিরাপত্তার শক্তিসহ একটি বৈচিত্র্যময় প্রযুক্তিগত ইকোসিস্টেম রয়েছে। ৬. টরন্টো, কানাডা : টরন্টোতে এআই, ফিনটেক এবং হেলথ টেকের শক্তির সঙ্গে একটি বিকাশমান প্রযুক্তি রয়েছে। ৭ অস্টিন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : অস্টিন সফ্টওয়্যার, গেমিং এবং উদীয়মান প্রযুক্তির ওপর ফোকাসসহ একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র হয়ে উঠছে। ৮. টালিন, এস্তোনিয়া : এস্তোনিয়া তার ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং ই-গভর্ন্যান্স সমাধানের জন্য পরিচিত, যা ট্যালিনকে একটি প্রযুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন শহর বানিয়েছে।
এশিয়ার বেশ কিছু দেশ তাদের পুরনো শহরগুলোকে সিলিকন ভ্যালির আদলে (টেক হাব) সাজিয়ে নতুন শহরের নামকরণ করেছে। যেমনÑ ফিলিপিন্সের দাভাও শহর এখন সিলিকন গার্লস। জাপানের কিউ সুদীপ এখন সিলিকন আইল্যান্ড। তাইওয়ানের সিঞ্চু এখন সিলিকন ভ্যালি অব তাইওয়ান। ইন্দোনেশিয়ার বান্দগে রয়েছে সিলিকন ভ্যালি অব ইন্দোনেশিয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে আছে সিলিকন ওয়েসিস। উদীয়মান এই টেক হাবগুলোকে বিভিন্ন কারণে সিলিকন ভ্যালিতে পৌঁছাতে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। যেমনÑ ১. ঐতিহাসিক সুবিধা : সিলিকন ভ্যালি একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম তৈরি করতে কয়েক দশক ধরে প্রতিভা, বিনিয়োগ এবং কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করে, যা এটিকে একটি উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য দেয়। ২. পুঁজিতে অ্যাক্সেস : সিলিকন ভ্যালিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম, দেবদূত বিনিয়োগকারীদের এবং উল্লেখযোগ্য তহবিলের অ্যাক্সেস রয়েছে, যা নতুন প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলোর প্রতিলিপি করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। ৩. ট্যালেন্ট পুল : প্রকৌশলী, ডিজাইনার এবং উদ্যোক্তাসহ অত্যন্ত দক্ষ প্রযুক্তি প্রতিভার একটি বিশাল পুল থেকে ভ্যালি উপকৃত হয়। ৪. নেটওয়ার্ক ইফেক্ট : সিলিকন ভ্যালিতে প্রযুক্তি কোম্পানি এবং স্টার্টআপগুলোর সমালোচনামূলক ভর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক প্রভাব তৈরি করে, যার ফলে সহযোগিতা, উদ্ভাবন এবং জ্ঞান ভাগাভাগি হয়। ৫. নিয়ন্ত্রক পরিবেশ : কিছু উদীয়মান প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রক এবং আমলাতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যা ব্যবসার বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনকে ধীর করে দিতে পারে। ৬. পরিকাঠামো : উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো একটি টেক হাবের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও উদীয়মান টেক হাবগুলোর বেশ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সিলিকন ভ্যালির বিকল্প অফার, বৃদ্ধি ও বিকাশ অব্যাহত রাখছে। আগ্রহী নতুন উদ্যোক্তা দেশ ও কোম্পানিকে সিলিকন ভ্যালির সমতুল্য সাফল্য পেতে কিছু নীতি ও কৌশল অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে টেক বিশেষজ্ঞগণ, তা হলো- ১. শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ : শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা এবং শক্তিশালী গবেষণা প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবনের ভিত্তি। সরকারের উচিত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (ঝঞঊগ) শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং গবেষণা উদ্যোগকে সমর্থন করা। ২. উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত: তহবিল, মেন্টরশিপ প্রোগ্রামগুলোতে অ্যাক্সেস প্রদান এবং ব্যবসা শুরু এবং চালানোর জন্য আমলাতান্ত্রিক তা দূরীকরণ। ৩. পরিকাঠামো : উচ্চগতির ইন্টারনেট, পরিবহন এবং সহ-কর্মক্ষেত্রসহ আধুনিক অবকাঠামো থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪. সমর্থন নেটওয়ার্কিং : একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম থাকা বাঞ্ছনীয়. যেখানে উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং বিশেষজ্ঞরা সহজেই ইভেন্ট, সম্মেলন এবং উদ্ভাবন হাব নেটওয়ার্কিং সহজ করতে পারে। ৫. নিয়ন্ত্রক পরিবেশ : ব্যবসাবান্ধব নিয়ন্ত্রক, নিয়ন্ত্রণ এবং উদ্ভাবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। ৬. অভিভাসন নীতি: অভিবাসন নীতিগুলোকে সমর্থন করা, যাতে সিলিকন ভ্যালিতে বিভিন্ন কর্মী বাহিনী উপকৃত হয়। ৭. সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা : সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করা, যাতে গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে এবং স্টার্টআপকে সহায়তা করতে পারে। ৮. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষা : উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে এবং উদ্ভাবকদের অধিকার রক্ষার জন্য শক্তিশালী মেধা সম্পত্তি সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ৯. ডিজিটাল লিটারেসি এবং স্কিল ট্রেনিং : কর্মীবাহিনীকে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতায় পারদর্শী করা। ১০. দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টি : একটি সমৃদ্ধ প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম তৈরির লক্ষ্যে সরকার এবং স্টেকহোল্ডারদের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত।
নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং বিশ্ব বাজারে বাজারজাত করার জন্য পৃথিবীর সমস্ত আবিষ্কারপ্রিয় মানুষের প্রিয় গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি। ১৯৫৯ সালে এই এলাকায় প্রায় ১৮০০০ উচ্চ-প্রযুক্তির চাকরি ছিল। ১৯৭১ সাল নাগাদ এই ধরনের প্রায় ১১৭০০০টি চাকরি ছিল এবং ১৯৯০ সালে প্রায় ২৬৮,০০০টি পদ পূরণ হয়েছিল। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সিলিকন ভ্যালি ২৩০,০০০ এরও বেশি চাকরি যোগ করেছে (২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে)। ক্যালিফোর্নিয়ার রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ এর অধিকাংশ। উচ্চপ্রযুক্তি কর্মীদের, বিশেষ করে প্রকৌশলী ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভিবাসন নীতিও শিথিল করেছে এই অঞ্চলের জন্য। সিলিকন ভ্যালির আদলে বাংলাদেশেও স্থাপন করা হয়েছে কয়েকটা হাইটেক পার্ক। এগুলোর কার্যক্রমে প্রয়োজন বিপুল সংখ্যক দক্ষ জনশক্তি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশজুড়ে হাইটেক পার্ক না বানিয়ে সিলিকন ভ্যালির মতো একটি এলাকাকে যদি তথ্যপ্রযুক্তির হাব হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে একদিকে যেমন দেশের আইটি খাত দ্রুত এগিয়ে যাবে, অন্যদিকে বিপুল লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। 

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×