বেনাপোল আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের দৃশ্য।
বেনাপেল স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী যাতায়াত অর্ধেকে নেমে এসেছে।আগে প্রতিদিন যেখানে ৭ থেকে ৮ হাজার যাত্রী দুদেশের মধ্যে যাতায়াত করত এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজারের নিচে। ভারতীয় দূতাবাস নিরাপত্তা জনিত কারন দেখিয়ে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ রাখায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে চিকিৎসা,ব্যবসা,উচ্চ শিক্ষা গ্রহনসহ জরুরী প্রয়োজনে অনেকে ভারতে যেতে না পেরে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে
উভয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে বেনাপোলের ওপারে ভারতের হরিদাসপুরে যাত্রী পারাপারের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের কার্যক্রম চালু হয়েছে। সে কারণে ভারতীয় অংশে যাত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে যে ভোগান্তি পোহাতো তা আর থাকছে না। তবে ভ্রমন করের অর্থ বছরে বছরে বাড়ানো হলেও নানা প্রতিশ্রুতির পরেও কাঙ্খিত সেবার মান বাড়েনি বেনাপোল বন্দরে।সে কারণে বেনাপোল চেকপোস্টে খোলা আকাশের নিচে কখনো রোদ কখনো বৃষ্টিতে ভিজে বাংলাদেশীদের গমন করতে হয় ভারতে। ভিসা প্রদান চালু ও সেবার মান বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী যাত্রীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান,বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য দেশের সবচাইতে বড় রুট বেনাপোল।এ বন্দর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার।তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্য যেকোন বন্দরের তুলনায় উন্নত। সে কারণে চিকিৎ,ব্যবসা,ভ্রমন ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহনে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাসপোর্টধারী বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল বন্দর ব্যবহার করে থাকে। প্রতিবছর এই বান্দর দিয়ে প্রায় ২৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করে থাকেন। সে হিসেবে অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে ৭থেকে ৮ হাজার যাত্রী যাওয়া আসা করে এ বন্দর দিয়ে। তবে জুলাই ও আগষ্টের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হলে নিরাপত্তা জনিত কারন দেখিয়ে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয় ভারত। শুধুমাত্র মেডিকেল ভিসা নিয়ে যাত্রীরা যাচ্ছে ওপারে। বর্তমানে অন্তবর্তিকালিন সরকার দায়িত্বগ্রহনের পর দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক হলেও ভিসা প্রদান চালু করেনি ভারতীয় দূতাবাস। এতে পাসপোর্টধারীর সংখ্যা কমে দাড়ায় ৩ হাজারের ঘরে। জরুরী প্রয়োজনে ভারত ভ্রমন করতে না পেরে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন,প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে তারা যেসব পণ্য আমদানি করেন তা ক্রয় করার আগে ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে যেয়ে পছন্দ করে কেনেন।কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে এখন তারা এ কাজ করতে পারছেন না। ফলে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের না পেয়ে ওপারের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর হোটেল মোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা তো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের।ওপারের একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার শতাধিক হোটেল ও তিন শতাধিক দোকানপাটের ব্যবসা মূলত বিদেশি অতিথিদের ওপর নির্ভর করে। এদের মধ্যে অধিকাংশ অতিথিই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বাংলাদেশিদের ভারত ভ্রমণ কমে যাওয়ায় কলকাতার হোটেল ও দোকানের ব্যবসা অন্তত ৮০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন তারা। এ প্রসঙ্গে কলকাতার বিশিষ্ট হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মনোতোষ সরকার জানান, মারকুইস স্ট্রিটে অবস্থিত তার সুপার গেস্ট হাউস ভোজ নামের একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। পর্যটক না থাকায় হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি জানান তার হোটেলে ৩০টি রুমের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটিতে বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথি আছেন। গত জুলাই থেকে হোটেলের এই অবস্থা চলছে। তিনি আরো বলেন,বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে যেকোনো সময় আমার হোটেলে বাংলাদেশি অতিথি রাখার জায়গা হতো না। সব সময় রুম বুক থাকত। বর্তমানে হোটেলের সবরুম ফাঁকা বলা চলে। অন্যদিকে
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি পর্যটক না যাওয়ায় ডজনখানেক রুম আছে, এমন অনেক ছোট হোটেল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব হোটেলের মালিকেরা বলছেন, একজন বা দুজন অতিথি নিয়ে তারা এসব হোটেল আর চালাতে পারছে না। মনোতোষ সরকার বলেন, ২০২১ সালে কোভিডের কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর যেমনটা হয়েছিল, ঠিক তখনকার মতো পরিস্থিতি এখন। তিনি জানান, বাংলাদেশের ঘটনাবলির পর ভারত সরকার নতুন ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি করেছে, সে কারণেই বাংলাদেশিদের কলকাতায় আসা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
এদিকে ভারত ভ্রমনে একজন পাসপোর্টধারীকে ভ্রমন কর বাবদ ১০৫৫ টাকা ও ভিসা ফি বাবদ ভারতীয় দূতাবাসকে ৮৪০ টাকা দিতে হয়। তবে বেনাপোল সীমান্তে যাত্রী সেবা না বাড়ানোয় ভোর সাড়ে ৩ টা থেকে সকাল ৯ টা পর্যন্ত সড়কের উপর পরিবার পরিজনদেরকে নিয়ে লম্বা লাইনে দাড়াতে হয়। বন্দরে একটি প্যাছেঞ্জার টার্মিনাল থাকলেও সেখানে বন্দর কর্মকর্তারা অফিসের কার্যক্রম করায় যাত্রীরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। নিরাপদ ভ্রমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি পাসপোর্টধারীদের।
ভারতগামী পাসপোর্টধারী জানান, ভিসা বন্ধ থাকায় অনেকে যেতে পাছেননা। ভ্রমন কর ও ভিসা ফি বাড়লেও সেবা বাড়েনি বেনাপোল বন্দরে। এদিকে বাংলাদেশী যাত্রীদের সেবার মান বাড়াতে ভারতের হরিদাসপুরে আন্তর্জাতিক মানের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল চালু করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। গত মাসের ২৭ তারিখে এই প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল উদ্বোধন করা হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই টার্মিনাল টি উদ্বোধন করেন। এর আগে বেনাপোল দিয়ে যারা হরিদাসপুর হয়ে কলকাতায় যেত তাদেরকে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে সময় লাগতো চার থেকে পাঁচ ঘন্টা। তাছাড়া পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হত যাত্রীদের।আন্তর্জাতিক মানের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল উৎপাদনের পর যাত্রীদের সেবার মান এখন থেকে বাড়বে। কারণ একই টার্মিনালের মধ্যে যাত্রীরা সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবেন। ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের বন্দর বিষয়ক সম্পাদক মো: মেহেরুল্লাহ জানান,ভিসা প্রদান বন্ধ থাকায় বাণিজ্যিক ভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী ভিসা না পাওয়ার কারণে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না বলে তিনি জানান।
বেনাপোল আন্তর্জাতিক প্যাছেঞ্জার টার্মিনালের ইনচার্জ তানজিলুর রহমান জানান, ভিসা বন্ধের কারনে পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত কমেছে এ বন্দর দিয়ে। তবে বেনাপোলে যাত্রী সেবা বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন ওসি ওমর ফারুক মজুমদার সোমবার(১২-১১-২৪) জনকণ্ঠের কাছে জানান, বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১১-১১-২৪ তারিখে ভারতে গেছে ২৩৪৮ জন।একই দিন ভারত থেকে এসেছে ২১৭১ জন। এর আগের দিন ১০-১১-২৪ ভারতে গেছে ১৮২৬ জন পাসপোর্টধারী যাত্রী।
নাহিদা