ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১

বেঙ্গলে কারুকথা

গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে নাগরিক রুচির মেলবন্ধন

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ৯ নভেম্বর ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে নাগরিক রুচির মেলবন্ধন

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে ‘কারুকথা’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে নকশিকাঁথা দেখছেন ক্রেতা

বাঙালির আদি ঐতিহ্যের সবই প্রায় গ্রাম থেকে পাওয়া। গ্রামের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে রেখে মানুষ শহরে আসে বটে। শেকড়ের টান ভুলতে পারে না। ফলে শহুরে রুচির সঙ্গে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেন তারা। অভিন্ন চিন্তার জায়গা থেকে কাজ করে আসছেন হস্ত এবং কারুপণ্য শিল্পীরাও। শিল্পীদের এই অংশটি ঐতিহ্য অটুট রেখে এর সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। এর ফলে দেশীয় হস্ত ও কারুপণ্যের এক ধরনের ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হচ্ছে। নিজস্বতার বোধ দ্বারা উজ্জীবিত অভিজাত নাগরিক সমাজ হয়ে উঠছে এসব পণ্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা।

কারুশিল্পীরাও পৈতৃক পেশা ধরে রাখার শক্তি পাচ্ছেন। এ কারণেই রাজধানীর নামিদামি ব্র্যান্ডের আউটলেটে নিয়মিতভাবে পাওয়া যাচ্ছে তাদের পণ্য। আর বর্তমানে এইসব পণ্য নিয়েই আলাদা করে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বেঙ্গল বই। ধানমন্ডির বেঙ্গল বই তরুণ তরুণীদের খুব পছন্দের জায়গা। এখানে সুবীর চৌধুরী চত্বরে কারুকথা শিরোনামে ১০ দিনব্যাপী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলছে এখনো। 
ছোট পরিসরে আয়োজন করা হলেও স্বনামধন্য তিন শিল্পীর হস্ত ও কারুপণ্য প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পীরা হলেন বিল্লাল ফরাজী, বিল্লাল উদ্দীন এবং আমিনুল ইসলাম। তিনজনই অ্যাওয়ার্ড অব এক্সেলেন্স ফর হ্যান্ডিক্রাফটস পুরস্কার বিজয়ী। ওয়ার্ল্ড ক্রাফটস কাউন্সিলের স্বীকৃতি পাওয়া শিল্পীরা আলাদা আলাদা স্টলে নিজেদের পসরা সাজিয়েছেন। জামদানি, নকশিকাঁথা এবং দারুশিল্পের নিদর্শন আকৃষ্ট করছে শহুরে প্রজন্মকে।  
শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম স্টলটিতে রাখা হয়েছে শুধুই জামদানি। বাংলাদেশের মহামূল্যবান মসলিনের উত্তরাধিকার এই জামদানি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জামদানির জন্য আলাদা জায়গা করে দিয়েছে সরকার। সেখানেই কাজ করেন বিল্লাল ফরাজী। প্রদর্শনীতে রাখা তার শাড়িগুলোতে আদি ফর্ম। দেখেই চেনা যায়, এগুলো জামদানি। তবে বিল্লাল জানান, তারা মূলত ঢাকার ডিজাইনারদের পরামর্শে কাজ করেন। জামদানির ট্র্যাডিশনাল চেহারাটা ধরে রেখেই একটু আধুনিকতার ছোঁয়া দেন। শাড়িজুড়েই সূক্ষ্ম কাজ করা হয়। প্রদর্শনীতে রাখা তেমন একটি শাড়িতে দেখা গেল তাসের ঘরের ফর্ম। মেরুন রঙের শাড়িতে এই ফর্ম বেশ নতুন লাগছিল।  
বিল্লাল জানান, এ ধরনের নতুন ডিজাইনের বেশি কাজ করা জামদানির মূল্য দাঁড়ায় ৫-৭ লাখ টাকা। কেন এত দাম? জানতে চাইলে তার বক্তব্য : একটি শাড়ির জন্য দুইজন কারিগরকে ৫-৬ মাস কাজ করতে হয়। বর্তমানে তার তত্ত্বাবধানে ২০টি তাঁত চালু আছে বলে জানান তিনি। বলেন, ঢাকার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশে তৈরি জামদানি। ইউরোপের বাজারে ভালো বিক্রি হয়। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে আগের মতো বিক্রি করতে পারছেন না। শৌখিন ক্রেতাদের বাসায় গিয়েও একসময় শাড়ি দেখিয়ে বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখন সেটি আর হচ্ছে না। সময় বদলাবে এমন আশায় আছেন বিল্লাল ফরাজী।     
দ্বিতীয় স্টলে চলছে নকশিকাঁথার প্রদর্শনী। সেখানে বেশ কিছু কাঁথা প্রদর্শন করা হচ্ছে। পেছনের দিকে মেলে ধরা একটি বড় কাঁথায় দেখা যায়, বিপুল কাজ। এন্ডিকটনের ওপর সুই সুতোয় গ্রামীণ নানা মোটিফ তুলে ধরা হয়েছে। স্টলেই কথা হয় সূচিশিল্প নিয়ে কাজ করা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, আদি নকশিকাঁথা যারা সেলাই করতেন তারাই এখনো কাজটি করছেন। ঝিনাইদহের প্রবীণ নারীদের সেলাই করা কাঁথা রাখা হয়েছে স্টলে। নিজের সংগ্রহে থাকা দীর্ঘ এবং ঘন নকশা করা একটি কাঁথার মূল্য ১ লাখ টাকা বলে জানান তিনি। এর বাইরে কাঁথাস্টিচে করা কুশন মাদুর ইত্যাদিও রাখা হয়েছে। 
দারুশিল্পের নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে তৃতীয় স্টলটি। স্টলে কাঠের তৈরি গয়নার বাক্স, টেবিলল্যাম্প, ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড, আয়না ও ছবি ফ্রেমসহ নানা ব্যবহার উপযোগী সামগ্রী। দারুশিল্পের এইসব কাজ করেছেন বিল্লাল উদ্দীন। তিনি বলছিলেন, বেশিরভাগ কাজই করেন হাত দিয়ে। মেশিনের তেমন ব্যবহার হয় না। এজন্য কয়েকবার শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষেন। কয়েক দফা রং করেন। তার পর ঢাকায় পাঠান। তার সব পণ্য দেশীয় ব্র্যান্ড আড়ংয়ে বিক্রি হয় বলে জানান তিনি। 
বিল্লাল বলেন, গ্রামের মানুষেরা কাজ করেন। তবে গ্রামে কেউ এত দাম দিয়ে আমার পণ্য কিনবে না। শহরেই মূল ক্রেতা। শহুরে ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই পণ্য তৈরি করেন বলে জানান তিনি। 
আয়োজক বেঙ্গল বই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রদর্শনী চলবে। সময় করে ঘুরে আসকে পারেন বৈকি।

×