শেরপুর সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি
অভয়াশ্রমের অভাবে থামছে না শেরপুর সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব। বরং দিনদিন তা চরম আকার ধারণ করছে। ওই অবস্থায় গত এক সপ্তাহ আগেও নালিতাবাড়ী উপজেলার বাতকুচি টিলাপাড়া এলাকায় ধানক্ষেতের বৈদ্যুতিক ফাঁদে একটি বন্যহাতির মৃত্যু হয়। এরপর থেকে ওই এলাকায় হাতির দল এখন অনেকটা আগ্রাসী অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিনই হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসছে এবং ধানক্ষেতে হানা দিচ্ছে। অনেক কৃষক হাতির পালের আক্রমণের ভয়ে ক্ষেতের আধপাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন।
অন্যদিকে সর্বশেষ বৈদ্যুতিক ফাঁদে একটি বন্যহাতির মৃত্যু নিয়ে গত এক যুগে ৩০টি বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাতির আক্রমণে মারা গেছেন ৩৫ জন মানুষ। ৭ নবেম্বর বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শেরপুর জেলা হাতি সংরক্ষণ সমন্বয় কমিটির এক সভায় ওই তথ্য উঠে এসেছে।
সভায় হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব নিরসনে এলাকার মানুষের মাঝে সচেতনতা আরো জোরদার করা এবং ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) টিমকে শক্তিশালী করার তাগিদ দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ইআরটি টিমকে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতিমালা আরও সহজিকরণ ও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় হাতি চলাচলের পথ বা করিডোর সংরক্ষণ এবং গারো পাহাড়ে হাতির অভয়ারণ্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া, হাতি উপদ্রব এলাকায় হাতির খাবারের উৎস সৃষ্টি করা এবং সোলার ফেন্সিং ও বায়ো ফেন্সিং কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
জেলা প্রশাসন এবং শেরপুর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ।
কমিটির অন্যান্য সদস্য ও আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে বক্তব্য রাখেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাবের আহমেদ, মধুটিলা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম, কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর, কৃষিবিদ মো. আমগীর কবীর, সাংবাদিক হাকিম বাবুল প্রমুখ।
জেলা প্রশাসক বলেন, মানুষকে যেমন থাকতে হবে, বাঁচতে হবে, বন্য হাতিকেও একইভাবে আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমাতে হবে। হাতি-মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ইআরটি টিমগুলোকে আরো সচেতন এবং শক্তিশালী করতে হবে। তিনি জানান, বনাঞ্চলে এবং আশপাশের অনেক এলাকার জমি খাস খতিয়ানের কিংবা বনবিভাগের। সে কারণে সেখানে বসবাসকারীদের ক্ষতিপূরণ পেতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হাতির কারণে যাদের আবাদ-ফসল, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি কিভাবে নিশ্চিত এবং সেটি নিয়ে কী করা যায় সেটি ভাবতে হবে। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হওয়ার কারণে এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে কিছু করা যায় কি-না, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হবে। স্থানীয়দের মধ্যে হাতি সুরক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, শেরপুর সীমান্তের বনাঞ্চলে এখন কমবেশি প্রায় ১২০টির মতো হাতি বিচরণ করছে। এগুলো পরিযায়ী হাতি হলেও এখন প্রায় ৪০-৫০টি বন্যহাতি দীর্ঘদিন ধরে শেরপুর সীমান্তেই অবস্থান করছে। এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত বন্যহাতির আক্রমণে নিহত, আহত ও আবাদ-ফসল, ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ২০০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই হাতির আক্রমণে নিহত আরো তিনজনের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে প্রদান করা হবে। সরকারের নিকট হাতির হামলায় নিহতের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ পরিবারপ্রতি তিন লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বৃদ্ধি করার একটি প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এছাড়া শেরপুর সীমান্তে বন্যহাতি সুরক্ষায় অভয়ারণ্য ঘোষণার বিষয়ে প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। তবে বনবিভাগের ২২ হাজার হেক্টর জমি ছাড়াও বনাঞ্চলে হাতি চলাচলের পথে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর খাস খতিয়ানের এবং প্রায় দুই হাজার হেক্টর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি রয়েছে। সেইসব ভূমি অধিগ্রহণের অনেক খরচ। যে কারণে এখনও হাতির অভয়ারণ্য করা যায়নি। তবে সীমান্তে সোলার ফেন্সিং এবং বায়ো ফেন্সিং করে এবং ইআরটি টিমের সংখ্যা বাড়িয়ে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা।