রাজধানীর অন্যতম ক্রাইম জোন মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক টানা অভিযান, গ্রেপ্তারেও থেমে নেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারি, সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ। চলমান যৌথ অভিযানে কয়েক শতাধিক মাদক কারবারি, সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মাদক কারবার নিয়ে আধিপত্য বিস্তার, সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রুপের সংঘাত চলেই আসছে। ক্যাম্পের ভেতরে বানানো হচ্ছে বোমা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসব বোমা ব্যবহার করা হয়। এতে সাধারণ মানুষেরও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ককটেল-বোমার আঘাতে মারা যান মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল গ্রুপের সদস্য রাজ ওরফে একগাল।
একই দিন সকালে ক্যাম্পের চার নম্বর সেক্টরে ‘শাকিল বুক’ স্টোরের পাশের ময়লায় ভাগাড়ে পড়ে থাকা ককটেল বিস্ফোরণে চার পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ আহত হন সাত জন। এ ঘটনায় এখনো পাঁচ জন সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মূলত ক্যাম্পের মাদক কারবারি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুনিয়া সোহেল গ্রুপ ও অন্যটি বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিম গ্রুপ। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে কেন্দ্র করে অন্তত অর্ধশতবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে এ দুটি গ্রুপে সদস্যরা। এসব সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ও বোমার আঘাতে সাত জনের মৃত্যুর পাশাপাশি শতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। এখনো কয়েকজন শরীরে আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন অবস্থায় ক্যাম্পে কি আদৌ শান্তি ফিরবে? এমন প্রশ্ন ক্যাম্পর সাধারণ বাসিন্দাদের।
কথিত রয়েছে দেশের কোথাও মাদক পাওয়া না গেলেও খোদ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে সবসময় মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। ক্যাম্পের অন্তত ২০টি স্পটে বিক্রি হয় গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা ট্যাবলেট। ক্যাম্পের কয়েকটি গ্রুপে নারী-শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের প্রায় দেড় হাজার মানুষ এসব মাদকদ্রব্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে রয়েছে আলাদা কয়েকটি গ্রুপ। তবে মাদক কারবারের মূলে রয়েছে প্রতিটি সেক্টরের লিডাররা।
জেনেভা ক্যাম্পের উত্তেজনা, সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষের নেপথ্যে কারা? এ নিয়ে ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেনেভা ক্যাম্পে ছোট ছোট খুপরি ঘরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। ক্যাম্পে ৯টি ব্লক বা সেক্টর রয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হবে শহরের মধ্যে এটি অন্য এক শহর। প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে দুই থেকে তিনটি মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী গ্রুপ। এসব গ্রুপ মূলত বিভিন্নভাবে মাদক কারবারে যুক্ত।
জানা যায়, ক্যাম্পে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলর এসব নেতাকর্মীর মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা। ক্যাম্পের আরেক লিডার আওয়ামী লীগের নেতা মোল্লা বশিরের মাধ্যমে মাদকের টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হতো। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বশিরের সঙ্গে মাদকের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় মাদক কারবারের অন্যতম লিডার বুনিয়া সোহেলের। এরপর মোল্লা বশির বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিমের সঙ্গে যোগ দিয়ে বুনিয়া সোহেলকে কোণঠাসা করার মিশন শুরু করেন। সেই থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত।
জেনেভা ক্যাম্পের সংঘাতকে কেন্দ্র করে বুনিয়া সোহেলের গ্রুপে যোগ দেয় ৭, ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টরের কয়েকটি গ্রুপ। এর মধ্যে কামাল বিরিয়ানি গ্রুপ, সৈদপুয়া গ্রুপ ও ভাইয়া সেলিম গ্রুপ অন্যতম। অপরদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা বশির চুয়া সেলিমের সঙ্গে সঙ্গে যোগ। এ ছাড়া ক্যাম্পের ১, ২, ৪, ৬ ও ৮ নম্বর সেক্টরের গ্রুপগুলোও চুয়া সেলিমের গ্রুপে যুক্ত হয়ে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপকে বিতাড়িত করতে শক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছে।
ক্যাম্পের প্রত্যেকটি গ্রুপেই একাধিক মাদক কারবারের গ্রুপ রয়েছে। মূলত ছোট ছোট গ্রুপের মাধ্যমে মাদক বিক্রি করা হয়। মাদক বিক্রির স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংকেও ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে প্রধান গ্রুপ ও গ্রুপের সদস্যরা প্রশাসন, ক্যাম্পের অন্যান্য সমস্যা এবং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কাজ করে থাকে। সম্প্রতি ক্যাম্পের সংঘর্ষে গ্রুপগুলোর লিডারদের কাছে ভারি অস্ত্র দেখা গেছে।
জেনেভা ক্যাম্পের চারপাশই মূলত উন্মুক্ত। যে কারণে বাধাহীনভাবেই এখানে মাদকদ্রব্য ঢুকছে। নারী ও বাচ্চাদের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য ঢোকানো হচ্ছে। এ ছাড়া ময়লার গাড়ি কিংবা বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর সঙ্গেও গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবাসহ যাবতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ে আসা হচ্ছে ক্যাম্পের ভেতরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখানকার এক মাদক কারবারি বলেন, দেশে যতদিন মাদক ঢুকবে, ততদিন ক্যাম্পেও মাদক আসবে। যখন প্রশাসনের অনেক কড়াকড়ি থাকে, তখন লুকিয়ে বিভিন্নভাবে আনা হয়। এখানে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়।
নন-লোকাল জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষক এসপিজিআরসি সংগঠনের আহ্বায়ক সৈকত আলী মাস্টার বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে মাদকদ্রব্য যে কোনোভাবেই আসতে পারে। ক্যাম্পের বাইরে ও ভেতরে খোলামেলা মাদক বিক্রি হচ্ছে। আর নিয়ে আসাত কোনো বিষয় নয়। তবে আমার কথা হলো এত চেকপোস্টের মধ্যেও কীভাবে সীমান্ত পার হয়ে দেশে আসছে। এই জবাব সরকারকেই দিতে হবে। সরকার চাইলে দেশে আর মাদক আসবে না।
এসপিজিআরসি সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, আমরা গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পের সার্বিক বিষয়ে একটা স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার এপিএস সাব্বির হোসেন এটি রিসিভ করেছেন। এরপর থেকে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। কী ছিল সেই চিঠিতে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পের ভেতরে কী কী অসুবিধা আছে, আমাদের কী কী চাহিদা, এই ক্যাম্পে আমরা কেন শান্তিতে থাকতে পারছি না- এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেনেভা ক্যাম্পে কারা সংঘর্ষ করছে, কেন সংঘর্ষ হচ্ছে, কারা মাদক ব্যবসা করছে- আমাদের পক্ষ থেকে এসব বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে।
জেনেভা ক্যাম্প পরিচালনার জন্য এনএলআরসি এবং এসপিজিআরসি নামে দুটি সংগঠন রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এ দুটি কমিটির নেতারা সবাই পলাতক। এরপর গত ১২ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দারা কমিটি দুটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে এসপিজিআরসির একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন।
মোহাম্মদপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার জানান, আমরা জানতে পেরেছি ক্যাম্পের ভেতরে তারা নিজেরাই বোমা তৈরি করছে। সবশেষ রাজ নামে যে ব্যক্তি খুন হয়েছে, সে হাত বোমার আঘাতেই মারা গেছে। এসব বোমা তারা নিজেরাই তৈরি করছে। গানপাউডার, ভেতরে কিছু লোহার টুকরা ও জরদার কৌটা দিয়ে বানাচ্ছে সেগুলো। তিনি আরও বলেন, আমরা বোমা কারিগরদের তথ্য সংগ্রহ করছি, কারা বোমা বানাচ্ছে এবং কাদের নিয়ন্ত্রণে বোমা বানানো হচ্ছে, কারা ক্যাম্পকে অশান্ত করে তুলছে। ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। যতদিন পর্যন্ত ক্যাম্পে অরাজকতা চলবে ততদিন আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।
শুধু তাই নয়; জেনেভা ক্যাম্পে বিভিন্ন আস্তানায় বসে বানানো হচ্ছে বোমা। দুই গ্রুপের অন্তত ১০ জন কারিগর এসব বোমা বানাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে টার্গেট করেই বানানো হচ্ছে বোমা। গত তিন মাসে ক্যাম্পে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ও হাত বোমার আঘাতে শিশুসহ ৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে বিস্ফোরণে আঘাতে মারা গেছে দুইজন। আহত হয়েছেন শিশু-নারীসহ অন্তত শতাধিক মানুষ। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি অর্ধশতাধিক ককটেল ও হাত বোমা উদ্ধার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে বোমা বানানো চক্রের এক সদস্য বলেন, গত মাসে হাত বোমা ও ককটেল বানানোর জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় চুয়া সেলিম গ্রুপের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পাঁচ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা লাড্ডু কসাই। বোমা অনেকেই বানাতে পারে। তবে এটা অনেক ঝুঁঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখন অল্প কয়েকজন কাজ করে। এর আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বোমা বানাতে গিয়ে একজন মারা যায়।
অন্যদিকে বুনিয়া সেলিমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যাম্পের সাত ও পাঁচ নম্বর সেক্টরে রয়েছে আরও কয়েকজন বোমা কারিগর। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বোমার আঘাতেই মারা যায় রাজ ওরফে একগাল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরের একটি রেস্তোরাঁয় বসে ছিল রাজ। সে সময় একদল লোক অস্ত্রসহ ক্যাম্পে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে মুখোশ পরা এক ব্যক্তি এলোপাতাড়ি বোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় রাজের ওপর একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়াও ওই সময়ে কয়েকজন বাসিন্দা বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। এর আগে ২৪ অক্টোবর হুমায়ুন রোডে ক্যাম্পের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণে দুজন আহত হন। আহতরা হলো- মোটর মেকানিক ওমর ফারুক (২০) ও মাংসের দোকানের কর্মচারী মো. লিটন (৩০)।
আহত লিটনের আত্মীয় মিজানুর বলেন, ক্যাম্পে প্রথম বোমা বিস্ফোরণে রাসেল (৮) নামে এক শিশু মারা যায়। জেনেভা ক্যাম্পের জন্মলগ্ন থেকে কখনো আগ্নেয়াস্ত্র বা ককটেল বোমা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এমন অশান্তি ক্যাম্পে আগে কখনো দেখেনি বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেলসহ শতাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্রসহ অর্ধশতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ক্যাম্পের আশপাশে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলমান রয়েছে।