ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

জেলপলাতক দাগি আসামিরা চালাচ্ছে তৎপরতা

সুন্দরবনে ফের বেপরোয়া দস্যু বাহিনী

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ৬ নভেম্বর ২০২৪

সুন্দরবনে ফের বেপরোয়া দস্যু বাহিনী

সুন্দরবনে ফের বেপরোয়া দস্যু বাহিনী

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে ফের অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক তৎপরতা শুরু হয়েছে। একসময় জেলে, বাওয়ালি থেকে শুরু করে পর্যটকরাও থাকতেন আতঙ্কে। ছয় বছর আগে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এখন আবারও সুন্দরবনে তৎপর হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ে জেল ভেঙে পালানো দাগি দ-প্রাপ্ত দস্যু এবং ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা সুন্দরবনে গিয়ে শুরু করেছে দস্যুতা।

জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। মুক্তিপণ আদায়ে জেলেদের আটক করার খবর পেয়ে বন বিভাগ অভিযানে নামে। এরপরও রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। বনদস্যুদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনটি নৌকা, সোলার প্যানেল ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে বন বিভাগ। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে। 
বন বিভাগ ও র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ে জেল ভেঙে পালানো দাগি আসামি ও দ-িতরা সুন্দরবনে ফের দস্যুতা শুরু করেছে। দীর্ঘদিন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত থাকলেও আবার নতুন করে দস্যুতা শুরু হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিরা। কয়েক মাসে জেলে অপহরণ, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে বেশ কয়েকজন। সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর রাতে পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকা থেকে মুক্তিপণ আদায়ের দাবিতে আটক রাখা বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন: আব্দুল আলিম (৬২), নূর ইসলাম (৪৫), রবিউল ইসলাম (২৮), হাফিজুর রহমান (৪৫), রাজু ফকির (৪৭), শফিকুল ইসলাম (৪৫), রফিকুল ইসলাম (৪৫), মফিজুর (৩৮), মুছাক সানা ও ছেলে নজরুল ইসলাম (৫৭)। উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানান, তাদেরকে বিভিন্ন সময় সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান থেকে বনদস্যু মঞ্জুর বাহিনী মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে। এই বাহিনীর প্রধান হিসেবে মঞ্জুর নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 
সাতক্ষীরা রেঞ্জের এসিএফ ইকবাল হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে বন বিভাগের সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যায়। ধ্বংস করা হয় বনদস্যুদের একটি আস্তানা।  এর আগে গত ২৮ জুলাই সুন্দরবনের টগিবগি এলাকা থেকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের ১৪ জেলেকে অপহরণ করে দস্যুরা।

অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আলাদাভাবে প্রত্যেক গ্রুপের কাছে দাবি করা হয় লাখ টাকার চাঁদা। বিকাশের মাধ্যমে কয়েকটি পরিবার কিছু টাকা পরিশোধও করে। তবে এরই মধ্যে অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালিয়ে ১৪ জেলেকে উদ্ধার ও পাঁচ দস্যুকে আটক করে র‌্যাব। উদ্ধার করা হয় দেশীয় অস্ত্র। সম্পদ আহরণে সুন্দরবনে গিয়ে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে আতঙ্কিত জেলেরা। 
সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহৃত জেলেরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তাদের কয়েকজনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এরপর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ ব্যাপারে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠায়। পরে একজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি টাকা দিলে বাকিদের ছাড়ার কথা বলে।

ছাড়া পাওয়া জেলে পরিবারে ফিরে যাওয়ার পর র‌্যাবকে জানায়। র‌্যাব বাকি জেলেদের উদ্ধার করে। তারা খুবই স্বল্প আয়ের মানুষ। জীবিকার তাগিদে সব ভয় উপেক্ষা করে সুন্দরবনে যান। তবে এমন হতে থাকলে তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এসব ডাকাতের শাস্তি চান অপহরণের পর উদ্ধার হওয়া জেলেরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বন বিভাগ সূত্র জানান, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের আকবর তরফদারের ছেলে আব্দুল্লাহ তরফদার (৪২) গত ১৪ সেপ্টেম্বর নারী পাচার মামলায় জেলে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙচুর হলে সেখান থেকে পালিয়ে কৈখালী ইউপির পারাণপুর গ্রামে তার এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নেয়। গত ৬ আগস্ট রাতে টেংরাখালি গ্রামের আরও কয়েকজন মিলে মিরগাং মোড় দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে।

বনদস্যুতায় নামা আব্দুল্লাহ বাহিনীর প্রধান আব্দুল্লাহর সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল ছিল। যাদের অধিকাংশ কারাগার থেকে পালিয়ে আসা বলে সূত্র জানায়। এদের বাড়ি সাতক্ষীরা এবং কালিগঞ্জের মৌতলায় বলে সূত্র জানায়। এ ছাড়া বনদস্যু আব্দুল্লাহর সহযোগী ডাকাত দল ফিরে এসেছে। 
জেলে রুবেল হোসেন ও আনোয়ার আলী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন, ১০ থেকে ১২ জনের একটি ডাকাত দল আব্দুল্লাহ বাহিনী সুন্দরবনের দারগাং, আঠারোবেকী, কাচিকাটা, রায়মঙ্গল, কচুখালী, মাওন্দো নদীতে অবস্থান করছে। তারা আমাদের ধরে নৌকায় যা পাচ্ছে সেগুলো তুলে নিচ্ছে। পুনরায় বনে প্রবেশ করলে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রবেশ করতে বলছে।
‘মেলাদিন পরে সুন্দরবনে আবার ডাকাত নেমেছে। নদীতে মাছটাছ তেমন হয় না। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ডাকাতির টাকা দেব নাকি ঋণ শোধ করব! বড় চিন্তায় আছি।’ এলাকার জেলেরা জানান, সুন্দরবনে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল জেলেদের কাছে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। তারা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের দায়িত্বে থাকা হাসনা জাহান বিথী বলেন, আব্দুল্লাহ তরফদারসহ ৭-৮ জন এখনো পলাতক রয়েছেন। জেল পলাতক আসামিদের ধরতে প্রশাসন কাজ করছে।
বন বিভাগ কর্মকর্তা বলছেন, দীর্ঘদিন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে বনদস্যু মুক্ত থাকার পর অতিসম্প্রতি আবারও বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাহিনীর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে ভারতে বসে এই বনদস্যু গ্রুপটি জেলেদের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করছে বলে জেলে-বাওয়ালিরা অভিযোগ করেছেন।

আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যু আলিম বাহিনীর প্রধান আব্দুল আলিম, মিলন, জিয়া, জনাব ও নুরু বর্তমানে ভারতে বসে এ চাঁদা দাবি করছে বলে তারা অভিযোগ করেন। এর ফলে সুন্দরবন নির্ভরশীল জেলে-বাওয়ালিদের মাঝে ফের বনদস্যু আতঙ্ক শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছর যাবৎ সুন্দরবন দস্যুমুক্ত থাকলেও দেশের পটপরিবর্তনের পর বর্তমানে ২/১টি বাহিনী নতুন নামে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বনদস্যু আলিম বাহিনীর প্রধান আলীম ভারতীয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বনদস্যু আকাশ বাহিনীর পরিচয়ে আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিলে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গেলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা মো. হাবিবুল ইসলাম জানান, দেশের পটপরিবর্তনের পর একটি গ্রুপ এ কাজটি করছে। তবে তারা কোনো সুবিধা করতে পারবে না। আমরা শক্ত অবস্থানে রয়েছি।
র‌্যাব-৬ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট এম সারওয়ার হুসাইন বলেছেন, দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে কেউ নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে র‌্যাব। এ ধরনের কোনো ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। নতুন করে কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে আমরা কঠোর হস্তে দমন করব। আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগেরও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ জানিয়েছেন, প্রথমত এখন সুন্দরবনে যাওয়া নিষেধ। এই সময়ে তারা কীভাবে বনের ভেতর গেল, এটার দায় বন বিভাগেরই। দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনে এ ধরনের তৎপরতা আবারও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। সুন্দরবনের প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে অনেকেই জীবন নির্বাহ করে। এ ধরনের অপরাধ চলতে থাকলে জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করতে সুন্দরবনে যেতে ভয় পাবে, হয়তো যাবেও না। এতে একদিকে যেমন তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে, অন্যদিকে সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায়ও কম হবে।

আতঙ্ক সৃষ্টি করলে সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এজন্য বন বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তারা বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুন্দরবনে টহল বাড়াতে হবে। বন বিভাগের জনবল বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর নজরদারি করতে হবে।

×