শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় সম্প্রতি একটি বন্যহাতি হত্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়ে পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম (৪০) নামের নিরীহ এক ভ্যানচালককে বন বিভাগের লোকজন জেলহাজতে প্রেরন করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবারের লোকজন।
পরিবারের সদস্যরা জানান ভুক্তভোগী শহিদুলের বাবা ছোরহাব আলীকেও বিগত ২০০৮ সালে একদল বন্যহাতি শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে আছার মেরে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শুধু শহিদুল ইসলাম নন এলাকার আরো ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো অনেক দরিদ্র অসহায় নিরীহ মানুষকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মামলার ভয়ে গ্রামের কৃষকরা বাড়ি ঘরে থাকছেন না। আর এই সুযোগে বিনা বাঁধায় কৃষকের সোনার ফসল খেয়ে শেষ করছে বন্যহাতির পাল।
সুত্রে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামের কৃষকরা গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) রাতে বন্যহাতির কবল থেকে তাদের চলমান আমন ফসল রক্ষা করতে জেনারেটরের সাহায্যে আলো জ্বালিয়ে রাখেন। এসময় বন্যহাতির দল তাদের ক্ষুধা নিবারনের জন্য কৃষকের ধান ক্ষেতে আসতে চাইলে স্থাপিত ওই জেনারেটরের তারে জড়িয়ে একটি মাদি বন্যহাতির মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় বনবিভাগের কর্মকর্তারা ওইদিন রাতেই বাতকুচি গ্রামের শহিদুল ইসলাম নামে এক ভ্যানচালককে আটক করে ও তারসহ জেনারেটরটি জব্দ করে। পরদিন মৃত বন্যহাতিটির ময়নাতদন্তের পর মাটিতে পুতে ফেলা হয়। এই ঘটনায় বনবিভাগের কর্মকর্তারা শহিদুল ইসলামসহ ১১ জনের নামে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় গত রবিবার (২ নভেম্বর) রাতে একই গ্রামের আরেক আসামি মোহাম্মদ আলীর পুত্র ইব্রাহিম মিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠায়। এই ঘটনায় বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামে গ্রেপ্তার আতংক বিরাজ করছে।
কারাবন্দী শহিদুলের স্ত্রী জামেলা খাতুন বলেন, আমার স্বামী নির্দোষ। ঘটনার দিন তিনি বাড়ির পাশে হাতি তাড়ানো দেখতে গিয়েছেন। এসময় গ্রামের মানুষ ও রেঞ্জকর্মকর্তার অনুরোধে ভাড়ার বিনিময়ে তার ভ্যানগাড়ী দিয়ে জব্দকৃত জেনারেটর ও জিআই তার মধুটিলা রেঞ্জ অফিসে পৌঁছে দিতে গেলে আটক করা হয়। আমার স্বামীকে কারাগারে পাঠানোতে আমাদের পরিবারের কোন রোজগারের লোক নেই।
এখন আমারা পরিবারের ৪ জন সদস্য খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করছি। আমরা সমিতি থেকে ঋন করে ভ্যানগাড়িটি কিনেছিলাম। এই ঋনের কিস্তির টাকা দিতে পারছি না। তাই আমার স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, একদিকে প্রতিদিন কৃষকের আধাপাকা সোনার ফসল খেয়ে সাবার করছে বন্যহাতির পাল। অপরদিকে, পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে দিয়েছেন এলাকার মানুষ। যদি গ্রামের লোকজন বাড়িতে থাকতেন তাহলে খড়কুটার আগুন, মশাল জ্বালিয়ে ও ডাকচিৎকার করে তাদের সোনার ফসল বাঁচাতে প্রাণপন চেষ্টা করতেন। কিন্তু মামলার ভয়ে কৃষক বাড়িতে না থাকায় বিনা প্রতিরোধে বন্যহাতির দল এখন দিনেরাতে আধাপাকা ধান খেয়ে সাবার করে দিচ্ছে।
এসব বন্যহাতিকে কোনক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এ যেন এলাকার আরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় কোন কোন গ্রামে আধাপাকা ধানই কাটা শুরু করেছেন কৃষকরা। এসব নানা বিষয় নিয়ে এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ মনোক্ষুণ্ণ হয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন মানুষ আগে, নাকি হাতি আগে। বন্যহাতির দাম বেশি নাকি মানুষের দাম বেশি ?। একইসাথে তারা সরকারের কাছে ওই বন্যহাতি হত্যা মামলা প্রত্যাহার ও বন্যহাতির অত্যাচার বন্ধের স্থায়ী সমাধানও চেয়েছেন।
ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী আরো জানান, পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে একদল বন্যহাতি তান্ডব চালিয়ে এলাকার বসবাসরত মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে আসছে। বিগত ২০০৮ সালে উপজেলার সীমান্তবর্তী পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামের কৃষক ছোরহাব আলী ও চলতি বছর একই গ্রামের কৃষক উমর আলীকে বন্যহাতির দল শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ও পা দিয়ে পিষে নিহত করে। নিহত ওই দুই পরিবার এখনো কোন প্রকার ক্ষতিপুরনের টাকা পাননি।
উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন ও বাতকুচি গ্রামের কৃষক আবদুল কাদির বলেন, এ বছর পাহাড়ি ঢলে আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। আরেকদিকে বন্যহাতিও আধাপাকা ধান খেয়ে শেষ করে চলেছে। আবার সরকারিভাবে হাতিকে উত্যক্ত করতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা কোন দিকে যাবো। যদি ফসল ঘরে তুলতে না পারি তাহলে আমাদেরকে না খেয়ে থাকতে হবে। আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই।
বাতকুচি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক উমর আলী ও কৃষাণী নুরেদা বেগম বলেন, এ বছর আবাদ অনেক সুন্দর হয়েছিল। কিন্তু বন্যহাতি আমাদের প্রায় পাকা ধান খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। বন্যহাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থদের সরকারিভাবে ক্ষতিপুরন দেওয়া হয় বিষয়টি আপনি জানেন কি ? এম প্রশ্নে তারা বলেন, কিছু সংখ্যক কৃষক ক্ষতিপুরন পেয়েছেন। তবে তারা জানান, ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের ক্ষতিপুরন পেতে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি দীর্ঘদিন সময় লেগে যায়।
তাছাড়া পাহাড়ি এলাকার মানুষের খ’ তফসিলভুক্ত জমি বেশি। রেকর্ডীয় জমির ক্ষতিপুরন যৌক্তিক সময় পাওয়া গেলেও খ’ তফসিলভুক্ত বেশির ভাগ জমির মালিকরা ক্ষতিপুরন পাচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপুরন প্রাপ্তীর ব্যাপারে আরো শর্ত শিথিল করার দাবি জানাই।
ময়মনসিংহ বনবিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যহাতির অত্যাচারের শুরুর দিকে কৃষকরা কোন প্রকার ক্ষতিপুরন পেতেন না। বর্তমানে বন্যহাতি দ্বারা নিহতের পরিবার সরকারিভাবে ৩ লাখ, আহত ব্যাক্তি ১ লাখ ও ফসলের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা ক্ষতিপুরন হিসেবে পাচ্ছেন সর্ব্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা।
ইতোমধ্যে মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীনে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষককে ক্ষতিপুরন হিসেবে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। একইসাথে বন্যহাতি ও মানুষের মাঝে দ্বন্দ্ব নিরসনে সতর্ক থাকতে এলাকায় মাইকিং করাসহ নানা ধরনের প্রচার প্রচারনা চালানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, বন্যহাতি দ্বারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করে দ্রুত ক্ষতিপুরন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরো জানান, যেহেতু কৃষকদেরকে সরকার ক্ষতিপুরন দিচ্ছে তাই আইন হাতে তুলে নিয়ে কোনক্রমেই বন্যহাতিকে উত্যক্ত বা হত্যা করা যাবে না। তাছাড়া বন্যহাতি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অবগত করবো।