রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো এখন অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিক্সার দখলে
রাজধানীর অলিগলি এবং আশপাশের এলাকায় চলছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক। এলোমেলো চলাচল, হুটহাট ঘোরানো, উল্টো পথে চলাচলের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রধান সড়কে দ্রুত গতির যানবাহনের সামনে হুট করে চলে আসছে ব্যাটারিচালিত রিক্সা। এতে গাড়ির গতি কমে যায়, সৃষ্টি হয় যানজটের। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কেই সময় নষ্ট হচ্ছে নগরবাসীর। এমন বিশৃঙ্খল চলাচলের জন্য প্রতিবাদ করলেও সাধারণ যাত্রী, অন্যান্য পরিবহনের স্টাফদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন রিক্সা চালকরা।
সম্প্রতি ঢাকা শহরের মূল সড়ক থেকে ব্যাটারিচালিত রিক্সা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেও রুখতে পারেনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। উল্টো শহরে ব্যাটারিচালিত রিক্সার সংখ্যা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা নগরবাসীর। এরা মৌমাছির চাকের মতো ঘিরে ধরে। আগে এমন ছিল না।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা প্রধান সড়কে অবৈধ যানবাহন বন্ধ এবং সড়ক আইন মানাতে কঠোর হচ্ছেন। প্রতিদিনই আড়াই থেকে তিন হাজার ব্যাটারি রিক্সার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবুও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে বাড়ছে যানজট এবং দুর্ঘটনার ঝুঁঁকি। এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন গ্যারেজে যৌথ অভিযানের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সরকারি ছুটির দিন শুক্রবার বেলা ৩টা। নীলক্ষেত মোড়। বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন লোকমান শেখ। হঠাৎ তার পায়ে ধাক্কা লাগল। পেছন ফিরতেই দেখেন উল্টো পথে আসা একটি ব্যাটারিচালিত রিক্সা তাকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। লোকমান বলেন, পায়ে হাল্কা ব্যথা লেগেছে। এর চেয়ে বড় দুর্ঘটনা তো ঘটে যেতে পারত।
সকাল সাড়ে ১০টায় ফার্মগেটে একটি ব্যাটারিচালিত রিক্সা আটকের চেষ্টা করেন এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। তিনি জানতে চান চালক রিক্সা নিয়ে কোথা থেকে এসেছে। রিক্সাচালক জানান, তিনি যাত্রী নিয়ে লালমাটিয়া থেকে এসেছেন। চালকের দাবি, তিনি আসতে চাননি, যাত্রী তাকে অনেকটা জোর করে নিয়ে এসেছেন। এ সময় যাত্রী বলেন, প্রতিদিনই রিক্সায় আসি, হাতে সময় কম, সামনে বাড়ান।
মাঠ পর্যায়ে ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাটারিচালিত রিক্সার মতো অবৈধ যানবাহন যে যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ তা মানতে চান না অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষও। তিনি বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এসব রিক্সার বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নেওয়ার অনুরোধ করে তাকে বলেছেন, এসব রিক্সা তো সাধারণের জন্য ভালো। আপনারা এদের ‘ডিস্টার্ব’ করেন কেন? তিনি বলেন, উনাকে বোঝাতে আমার ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয় হয়েছে।
রাজধানীর নিউ মার্কেট, গুলিস্তান, মিরপুর, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলতে দেখা গেছে। এসব এলাকায় সরেজমিন ঘুরে ও কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহরে দুই ধরনের রিক্সা চলাচল করে, যার মধ্যে একটি ছোট ব্যাটারিচালিত রিক্সা। যেগুলোতে ২-৩ জন বসতে পারে। আরেকটি বড় রিক্সা, যেগুলোতে ৫-৬ জন বসতে পারে। দিনের শুরুতে সাধারণত বড় ব্যাটারিচালিত রিক্সাগুলো মূল সড়কে ওঠে না। তবে সন্ধ্যার পরই দুই ধরনের রিক্সাই মূল সড়কে দাপিয়ে বেড়ায়।
মিরপুরের পল্লবী, ১১ নম্বর ও ১০ নম্বর মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি ও লিফটের সামনে ব্যাটারিচালিত রিক্সার ভিড়। আছে প্যাডেল চালিত রিক্সাও। মেট্রো স্টেশন ঘিরেই সেখানে এসব রিক্সার বাড়তি চাপ। অনেকে যেমন মেট্রো থেকে নেমেই উঠে যাচ্ছেন রিক্সায় আবার অনেকে বিভিন্ন গন্তব্য থেকে মেট্রো স্টেশনে আসছেন এসব বাহনে। স্টেশনের গেটে রিক্সার এমন জটলায় কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের।
সেখানে কথা হয় সুইটি নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মেট্রো স্টেশন থেকে নেমে হাঁটার মতো অবস্থা নেই। ফুটপাতে হকার, সড়কে ব্যাটারিচালিত রিক্সা মৌমাছির চাকের মতো ঘিরে ধরে। রাস্তা পারাপারে বেশ কষ্ট হয়।
একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট ও খাবারের দোকান থাকায় মিরপুর ১২ নম্বর মোড়ে বাস, প্যাডেলচালিত ও ব্যাটারিচালক অটোরিক্সার ভিড় লেগেই থাকে সব সময়। কখনো কখনো লেগে যায় জট। কোনো পথচারী সেতু না থাকায় এই মোড়ে যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। দেখা যায়, মূল সড়কে অটোরিক্সার বেপরোয়া চলাচলে বিপদে পড়ছে দ্রুতগতির যানবাহনগুলো। ট্রাফিক ও কমিউনিটি পুলিশের তৎপরতাও এসব অটোরিক্সার খামখেয়ালিপনা থামাতে পারছে না।
ট্রাফিক পুলিশ মূল সড়কে রিক্সা ধরা শুরু করলে একজন চালক অন্যদের সতর্ক করে দেয়। ফলে এসব যান ঠেকানো যায় না। এক্ষেত্রে পুলিশও নিরুপায়। যাত্রীদের অনেকে অটোরিক্সা চালককে মূল সড়কে যেতে বাধ্য করেন। তখন পুলিশ রিক্সা আটকিয়ে রাখতে চাইলেও যাত্রী আইন না মেনে উল্টো পুলিশকে ধমকাতে থাকেন। এমন ঘটনাও দেখা গেছে কয়েকটি স্থানে।
এসব এলাকার একাধিক ব্যাটারির রিক্সার চালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, আগে বিভিন্ন অলিগলিতে রিক্সা চালাতেও টোকেন নিতে হতো ১২শ’ টাকা খরচ করে। এখন আর রাস্তায় কোনো চাঁদা দিতে হয় না। চার্জিং খরচ আর রিক্সার জমা ছাড়া রাস্তায় কোনো বাড়তি খরচ নেই। তা ছাড়া যাত্রী নিয়ে যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারছেন, কেউ বাধা দিচ্ছে না। আয়ও হচ্ছে বেশি। তবে অটোরিক্সা চালকদের অনেকের দাবি, কিছু অনভিজ্ঞ চালক আছেন, যারা এ কাজগুলো করেন। তারাই বেশি ভাড়ার লোভে মূল সড়কে উঠে যান। তাদের কারণে অন্য চালকদেরও অভিযোগের মুখে পড়তে হয়। এসব চালকের কারণে সাধারণ চালকদের মোটর ও রিক্সা ডাম্পিংয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কালশী মোড়ে কথা হয় রিক্সাচালক ইমনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন মোটর খুলে নিয়ে যায় ট্রাফিক পুলিশ। পরে আর ফেরত দেয় না। একটা মোটরের দাম ৪-৫ হাজার টাকা। এ জন্য অনেকেই মূল সড়কে যান না। তবে যাত্রীদের অনেকে রিক্সাচালকদের মূল সড়কে উঠতে উৎসাহিত করেন।
পথচারীরা বলছেন, রাস্তা পারাপার করার সময় তারা ঝুঁকিতে থাকেন। কেননা, প্যাডেলচালিত রিক্সার গতি বুঝে রাস্তা পার হওয়া যায়। কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার ক্ষেত্রে গতি বোঝা মুশকিল। দূরত্ব বুঝে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন, আর তখনই হঠাৎ করে গতি বাড়িয়ে অটোরিক্সা কাছাকাছি চলে আসে। তখন সামনে এগিয়ে যাবেন, নাকি পেছনে যাবেন বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক সময় মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান। এতে গায়ের ওপর উঠিয়েও দেয়, ঘটে দুর্ঘটনা। তারা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা তুলে দেওয়ার দাবি জানান।
কমিউনিটি পুলিশের সদস্য সাদাফ বলেন, আমরা তো উনাদের (রিক্সাচালকদের) জরিমানা করি না। বারবার বুঝিয়ে বলি। তার পরও আমাদের ফাঁকি দিয়ে তারা উল্টো পথে এবং মূল সড়কে চলাচল করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, এই যানবাহনগুলো মূল সড়ক বা মহাসড়কে চলার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, সড়ক আইনেও নিষিদ্ধ রয়েছে। তাৎক্ষণিক স্বস্তি পাওয়ার জন্য মূল সড়ক থেকে এসব যানবাহন সরাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঢাকার বাইরে থেকে যেসব রিক্সা-অটোরিক্সা এসেছে, এগুলো নগরীর চার্জিং পয়েন্টগুলোতে (গ্যারেজ) চার্জ দিচ্ছে।
চার্জিং পয়েন্টগুলোতে পুলিশ প্রশাসন, বিআরটিএ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সমন্বয়ে যৌথ উদ্যোগে অভিযান চালাতে হবে। যেসব ওয়ার্কশপে এসব অবৈধ যানবাহন তৈরি হচ্ছে সেসব স্থানেও অভিযান চালানো প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে মোটরসহ যন্ত্রপাতি আমদানির বিষয়েও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
ডিএমপির সূত্র মতে, ২০ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে চার হাজার ১৫৪টি মামলা করা হয়েছে। আর এসব মামলায় এক কোটি ৪৭ লাখ সাত হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এ ছাড়া অভিযানকালে ৩৫২টি গাড়ি ডাম্পিং ও ২৪৭টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে। নগদ জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৪৩ হাজার ১৫০ টাকা। কিন্তু তাতেও কমেনি ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করার সংখ্যা। এগুলোর মধ্যে বেশি অনিয়ম করছে ব্যাটারিচালিত রিক্সা বা ইজিবাইক।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার ব্যাটারিচালতি অটোরিক্সার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারও রিক্সার তার ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, কারও সিট খুলে নেওয়া হচ্ছে। এ রকম লঘুশাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে জনবল এবং যানবাহন স্বল্পতার কারণে রেকারিং কিংবা ডাম্পিং করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা দিন দিন কঠোর হচ্ছি। পর্যায়ক্রমে সড়কে এ ধরনের একটি যানও চলতে দেওয়া হবে না।