ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দুই বংশের চেয়ারম্যানের বিরোধে নিঃস্ব গ্রামবাসী

নিজস্ব সংবাদদাতা,ভৈরব,কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ২ নভেম্বর ২০২৪

দুই বংশের চেয়ারম্যানের বিরোধে নিঃস্ব গ্রামবাসী

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার টি ইউনিয়নের মধ্য একটি ইউনিয়ন সাদেকপুর। এই ইউনিয়নের একটি দাঙ্গাবাজ গ্রাম মৌটুপি। সাত হাজার মানুষের ওই গ্রামে রয়েছে দুটি বড় বংশ। কর্তা বংশ আর সরকার বংশ। সাদেকপুর ইউনিয়নে দুই বংশের নেতারাই বার বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়।

বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ সাফায়েত উল্লাহ সরকার বংশের লোক। এর আগে তার বাবা আবুবকর সিদ্দিক  তিনবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। অন্যদিকে সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক কর্তা বংশের লোক। দুই বংশের দুই চেয়ারম্যান এখন তাদের নিজ বংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

৫৪ বছর যাবত তারা দুজন গ্রামের  আধিপত্য বিস্তার, পূর্ব শত্রুতার জেরে দুই বংশের  ১৭  টি খুন হয়েছে। এতে কমপক্ষে শতবার সংঘর্ষ, বাড়ীঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বার বার  মারামারি সংঘর্ষে কমপক্ষে হাজারও  মানুষ আহতও হয়েছে। সর্বস হারিয়েছে গ্রামবাসী।

শনিবার দুপুরে সরজমিনে গ্রামটি ঘুরে শুধু ধ্বংসস্থপ দেখা গেছে। গ্রামটি জনমানব শূন্য হয়ে পড়েছে।শুক্রবারের সংর্ঘষের ঘটনায় গ্রামটিতে আগুন দেয়া হয়। কোথাও কোথাও আগুন জ্বলতে দেখাগেছে। আগুন নেভানোর কেউ নেই। বড় মানুষ এলাকায় নেই। সবাই অনত্র সরে গেছে। শিশুরা এসেছে তাদের ভিটা বাড়িতে। কিন্ত ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায় নিজ ঘর চিনতে পারছেনা অনেকে।

জানাগেছে,শুক্রবার দুপুরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে কাইয়ূম মিয়া (৪৫) নামের সরকার বাড়ীর এক ব্যক্তি খুন হয়। এদিন আহত হয় অন্তত ৫০ জন। এর কয়েকদিন আগে ইকবাল মিয়া (২৯) নামের একজন একই বংশের খুন হয়। গত ঈদুল আজহার পরদিন কর্তা বংশের নাদিম মিয়া (৫৫) খুন হয়।

এর আগে ২০০৫ সালে সরকার বাড়ীর সাফায়েত চেয়ারম্যানের আপন দুই ভাই ওবাইদুল্লাহ হেদায়েত উল্লাহ কর্তা বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়। বহু বছর আগে আরও একাধিক ব্যক্তি ঝগড়া সংঘর্ষে খুন হয়েছে। এসব খুন সংঘর্ষের  ঘটনায় এখনও অর্ধশত মামলা আদালতে চলমান আছে। আসামীর সংখ্যা দুই বংশের কয়েক হাজার হবে। দুইজন বর্তমান সাবেক চেয়ারম্যান কেউ এলাকায় থাকেননা।

তাদের বাড়ীঘর থাকলেও তারা ভৈরব শহরে বাসায় বসবাস করে এলাকায় ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে অপরাধের সাথে যুক্ত থাকেন। একাধিক খুনের মামলার আসামী তারা দুজন চেয়ারম্যান। কখনও আদালত থেকে জামিন নেন, আবার কখনও নেয়না। পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারেনা। পুলিশের ভাষায় তারা পলাতক।

মৌটুপি গ্রামে পুলিশ মামলার আসামী গ্রেফতার করতে যায়না, যদি কখনও যায় তবে অর্ধশত পুলিশ দল বেঁধে যেতে হয়। নতুবা পুলিশ প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারেনা। ঝগড়া সংঘর্ষ হলে পুলিশ সহজে এই গ্রামে যেতে চায়না। কারন জঙ্গী দাঙ্গাবাজ গ্রামে যেতে পুলিশও ভয় পায়।

স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বহুবার চেষ্টা করেও দুই বংশের বিরোধ মীমাংসা করতে পারেনি। বিশেষ করে দুই চেয়ারম্যান মীমাংসায় সম্মতি দেয়না। তারা মামলাবাজ হিসেবে চিন্হিত রয়েছে। কারন মামলা করলে দুই চেয়ারম্যানের টাকার বানিজ্য জমে উঠে।

কোন পক্ষ কোন ঘটনায় মামলা করলে মামলায় আসামী করার ভয় দেখিয়ে লোকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করে। আবার চার্জশীট থেকে নাম কেটে দিবে বলেও টাকা বানিজ্য করে বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা দুজনই টাকা বানিজ্যের কথা অস্বীকার করেছে।

মৌটুপি গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, আমরা অন্য বংশের লোক হয়েও বাঁচতে পারিনা। কোন না কোন বংশকে সমর্থন করতে হয়। গত ৫৪ বছরে এই গ্রামে কমপক্ষে দেড় ডজন খুন হয়েছে, আহত হয়েছে হাজারও মানুষ। মামলা হয়েছে শত শত। এসব বিরোধের মূল হোতা দুই চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ তোফাজ্জল হক।

একই গ্রামের বৃদ্ধ হাফিজ মিয়া বলেন দুইজন চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করলেই মৌটুপি গ্রাম নিরব হয়ে যাবে। গত কয়েকমাস আগে কর্তা বাড়ীর নাদিম খুন হলে সরকার বাড়ীর অন্তত ২০০ বাড়ীঘর লুটপাট অগ্নিসংযোগ হয়। পালিয়ে যায় সরকার বাড়ীর শত শত  পরিবারগুলি।

পরে সরকার বংশের  ইকবাল খুন হলে কর্তা বংশের শতাধিক বাড়ীঘর লুটপাট হয়। গতকাল তারা বাড়ী আসলে আবারও সংঘর্ষে কাইয়ূম খুন হলো। মানুষ বলছেদুই চেয়ারম্যানকে পরবাসে পাঠালে গ্রামের বিরোধ থামবে, নতুবা নয়।

এবিষয়ে সরকার বংশের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ,লীগ নেতা  মোঃ সাফায়েত উল্লাহ বলেন, কর্তা বাড়ীর বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক এই বিরোধ লাগিয়ে রেখেছে। তারা আমার দুই ভাইকে হত্যা করেছে। শুক্রবারের সংঘর্ষের নায়ক সে। গ্রামের যেকোন মীমাংসায় আমি রাজী কিন্ত তোফাজ্জল হক মীমাংসায় রাজী নয়। গ্রামের দাঙ্গার জন্য সে দায়ী।

কথা হয় কর্তা বংশের বিএনপি নেতা সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হকের সাথে। তিনি বলেন ৫৪ বছর আগে সাফায়েতের বাবা আমার বংশের কফিল উদ্দিনকে গলা কেটে হত্যা করে। কদিন আগে খুন করল আমার ভাই নাদিমকে। আরও খুন করেছে কয়েকজনকে। আমি গ্রামে থাকিনা, থাকি ভৈরব শহরে। অথচ একাধিক ঘটনায় সাফায়েত মামলায় আমাকে আসামী করে। কিভাবে মীমাংসা করব।

ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ ( ওসিমোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ জানান, আমি থানায় যোগদান করেছি দুইমাস হলো। এরই মধ্য দুটি খুন হলো মৌটুপি গ্রামে।

৫৪ বছর যাবত গ্রামের দুই চেয়ারম্যানের বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার চলছে জানলাম। স্থানীয় জনগন গ্রামকে দাঙ্গাবাজ গ্রাম বলে ডাকে। তবে আইন শৃংখলা দমন নিয়ন্ত্রণে আমি চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, শুক্রবারের সংর্ঘষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত জনকে আটক করা হয়েছে।

×