ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার

তিস্তা গিলে নিচ্ছে একের পর এক বসতবাড়ি

লালমনিরহাট প্রতিনিধি।

প্রকাশিত: ১৯:২২, ২ নভেম্বর ২০২৪

তিস্তা গিলে নিচ্ছে একের পর এক বসতবাড়ি

আদিতমারী উপজেলার চর গোবর্ধন এলাকায় তিস্তার নদী ভাঙ্গন

অসময়ে তিস্তা গিলে নিচ্ছে একের পর এক বসতবাড়ি, ফসলি জমি আর রাস্তাঘাট। ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে একের পর এক পরিবার। গত ১৫ দিনে লালমনিরহাট সদর ও আদিতমারী উপজেলাতেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি। এ ছাড়াও ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে ৫০০ হেক্টর ফসলি জমি। দিন যতই যাচ্ছে, ভাঙনের তীব্রতা ততই বাড়ছে।

লালমনিরহাট সদর, আদিতমারী ও হাতীবান্ধা উপজেলায় তিস্তাপাড়ে ১৬টি পয়েন্টে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রায় ১৫০ হেক্টর ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।  ভাঙ্গন কবলিতরা বাপ-দাদার ১০০ বছরের পুরাতন বসতভিটা চলে গেছে তিস্তার গর্ভে বিলিন হওয়াতে উচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যা পরবর্তী সময়ে পানি নেমে যাওয়াতে শুরু হয়েছে তিস্তায় তীব্র ভাঙন।

দফায় দফায় আকষ্মিক বন্যা আর ভাঙনে নিঃস্ব তিস্তাপাড়ের মানুষ। জেলার সদর উপজেলার হরিণচওড়া, রাজপুর, আদিতমারী উপজেলার চর গোবর্ধন, চর গরিবুল্লাহ,হাতিবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারীসহ ১৬ টির অধিক পয়েন্টে তিস্তার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানি যতই কমছে ততই আগ্রাসি হচ্ছে খরশ্রোতা তিস্তা। চোখের সামনে শতশত একর ফসলি জমি ও নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। গত কয়েকদিন সড়েজমিন তিস্তা চর ঘুরে দেখা গেছে আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন, গরিবুল্লাপাড়া, সদর উপজেলার হরিণচড়া ও হাতীবান্ধা উপজেলার পাউয়াবাড়ী গ্রামে ভাঙন কবলিত হয়েছে। এ ছাড়া, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, গোকুন্ডা, চর গোকুন্ডা, কালমাটি, আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড়, বালাপাড়া, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ও চর গড্ডিমারী এবং পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

মর্নেয়া চর এলাকার ছকমল মিয়া জানান কয়েক দিন থেকে একটু একটু পানি কমার দিকে আছে। পানি কমার সাথে সাথে চর গোকুন্ডার অনেক বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ভাঙ্গন আতঙ্কে রয়েছি। গরিবুল্লাহপাড়া এলাকার ফরহাদ মিয়া জানান,তিস্তা পানি বৃদ্ধি ও কমার সময় ভাঙ্গন শুরু হয়। প্রতি বছর ভাঙ্গন কবলে পরে হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। আমাদের  ত্রাণ দরকার নেই তিস্তা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হলে তিস্তা পাড়ের লোকজন স্থায়ীভাবে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে।

আদিতমারী উপজেলার চর গোবর্ধন এলকার বাসিন্দা রোমেনা বেওয়া (৭০) এর সাথে ভাঙ্গন বিষয়ে প্রতিবেদকের কথা হয়, তিনি জানান, এ বয়সে ৩০ থেকে ৪০ বার নদী ভাঙ্গনের কবলে পরেছি, বন্যার সময় আকষ্মিক শুনি যে উজানের ঢল আসা শুরু হয়েছে। প্রস্তুতি নিতে না নিতেই ঘর বাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়, কোন মতে জাহান টা নিয়া স্পার বাঁধ, আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেই, কয়েকদিন পরে পানি কমে গেলে বাড়ি ফিরে দেখি কিছুই নেই, আবার হাড়ভাংগা পরিশ্রম করে সোজা হবার চেষ্টা করলে শুরু হয় ভাঙনের তীব্রতা, বন্যা কবলিত অবশিষ্ট যা থাকে শেষ সম্বলটুকু নদী গর্ভে বিলিন হয়। এভাবে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ির সংগ্রামী জিবন। এখন আর ভয় লাগে না স্বামী মারা গেল, একমাত্র ছেলে ছেড়ে গেল,নদী ভাঙ্গন আমাকে ছাড়লো না।

কিছু দিন আগে মতি মেম্বার ভোটার আইডি ছবি নিয়ে গেলো,যার যার বাড়ি ভাঙ্গছে তাদের নাকি সরকার সহায়তা দিবে, সহায়তা কিসের কি, ইউএনও স্যার ২৫০০ করে টাকা দিয়েছেন, বলেন তো এটা দিয়ে কি হয়। এত সংগ্রামী জিবন বর্তমানে কিভাবে নির্বাহ করছেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, নিজের আর স্বামীর যা সহায় সম্বল ছিল তা নদী বিলিন করে দিয়েছে। এখন এক মেয়ে ঢাকায় থাকে সে প্রতি মাসে কিছু টাকা দেয়, বিধবা ভাতার টাকা পাই, এ দিয়েই খেয়ে না খেয়ে চলছি। এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন,সেই কবে থেকে শুনিছি যে নদী শাসন করা হবে, ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মান করা হবে, কিন্তু হলো না দ্রুত সময়ের মধ্যে মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নের দাবী জানান তিনি।

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মতিয়ার রহমান মতি জানান,গত দুই সপ্তাহে গোবর্ধন ও গরিবুল্লাপাড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক বসতভিটা ও প্রায় ১৫০ বিঘা আবাদি জমি তিস্তায় নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আরও দুই শতাধিক বসতভিটা ও শতাধিক বিঘা আবাদি জমি ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হলে জরুরিভিত্তিতে ভাঙন ঠেকাতে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি,অনেক বলার পরে পাউবো ২০০টি জিও ব্যাগ দিয়েছে। তাতে বালি ভর্তির জন্য খরচের টাকার কথা বলা হলে সেচ্ছাশ্রমে করতে বলেন।  পরে ব্যাগে বালি ভর্তি করা যায়নি, ব্যাগ গুলো পরিষদে পরে আছে।

এ ব্যাপারে পাউবো  লালমনিরহাট নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, তিস্তার কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, বর্তমানে ফান্ড নেই ফান্ড ক্রিয়েটের ব্যবস্থা করে কাজ করা হবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার জনকণ্ঠ কে  বলেন, তিস্তায় ভাঙ্গনের খবর পেয়েছি,  ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা করে ঢেউটিন দেয়া হবে। তাদের সার্বিক খোঁজ খবর রাখতে ইউএনওদের বলা হয়েছে।

রিয়াদ

×