ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি 

কর্ণফুলী টানেলে দৈনিক  লোকসান ২৭ লাখ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ০০:৩২, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

কর্ণফুলী টানেলে দৈনিক  লোকসান ২৭ লাখ টাকা

.

 কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল নিয়ে যে উচ্ছ্বাস ও স্বপ্নের কথা বলা হয়েছিল, তার বাস্তবতা বহুদূর। ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হলো। চট্টগ্রাম নগর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দ্রুত যোগাযোগের জন্য নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত সড়ক টানেল মূলত ঋণের বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়, বলছেন  যোগাযোগ বিশেজ্ঞরা। বর্তমানে এই টানেলের ব্যয় আয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। ফলে দৈনিক   লোকসন  হচ্ছে প্রায় ২৭ লাখ টাকা।

প্রতিদিন ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশও টানেল থেকে আয় না হওয়ায় এ গলা কাঁটার নিয়ে বিকল্প ভাবনাও চলছে। তবে কেউ কেউ আবার এভাবে ভাবতে নারাজ। কারণ, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ঘিরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আওতায়। কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড়ে শহর ও শিল্পায়ন হলেই মিলবে এর সুফল। 
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র লোক দেখানো ও আলোচনার জন্য এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বিগত সরকার। ফলে কাঁড়িকাঁড়ি অর্থ ব্যয় হওয়া ছাড়া লাভের দেখা মিলছে না। টানেলের দুইপ্রান্তের মধ্যে দক্ষিণপ্রান্তে যত শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার কথা জানানো হয়েছিল, তা মূলত ‘কথার কথা’ বলছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। টানেল কার্যালয় সূত্রমতে, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি গাড়ি চলাচল করেছে, যাতে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা টোল আদায় হয়েছে।
কর্ণফুলী টানেলে শুরু থেকে নিয়োজিত শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক মাসে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল কমেছে। শুরুতে টানেল দেখার জন্য অনেক লোক গাড়ি নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে। কিন্তু শিল্প কারখানা কিংবা ব্যবসার কারণে এখনো অতটা নির্ভরতা পায়নি টানেল। 
একই কথা ভিন্নভাবে জানান চট্টগ্রামের শীর্ষ এক পোশাক রপ্তানিকারক। নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি কোনো সরকারের পক্ষে না। তবে টানেল ব্যবসায়ীদের স্বার্থে না। টানেল নিয়ে আমার শুরু থেকে আপত্তি ছিল। কেন নদীর তলদেশে টানেল লাগবে এ নিয়ে চেম্বারের এক সভায় আমি কথা তুলেছিলাম, তখন অনেকে বিষয়টিকে সরকারবিরোধী বলে তকমা দিয়েছিল। তবে এটা তো বলতে হবে, টানেল দিয়ে আমাদের লাভ কোথায়? এর উত্তর পাওয়া যায়নি। কাল্পনিক একটি সমীক্ষা মাথায় তুলে সকলে দৌড়ালাম। এভাবে অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্প নিয়ে শিল্প ও যোগাযোগের  কোনো উপকার হয়নি। বরং এটা ঘুরে দেখতে যায় লোকজন। কোনো শিল্পপণ্য কিংবা ব্যবসায়িক কারণে এ টানেলের কার্যকারিতা নেই।
অপরদিকে টানেল বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মতে, এই সুড়ঙ্গপথের মূল ধারণায় রয়েছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন।’ অর্থাৎ নদীর দক্ষিণ পাড়েও গড়ে উঠবে শহর ও শিল্পায়ন। আনোয়ারা প্রান্তেও শহর সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যেই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। যেহেতু শহর গড়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ তাই এখনই টানেল থেকে প্রত্যাশিত আয় হওয়ার আশা করাটাও যৌক্তিক নয়। টানেল থেকে যতই সড়ক সম্প্রসারিত হবে ততই হবে নগরায়ন ও শিল্পায়ন। এটি নির্মাণ করা হয়েছে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে।  
সেতু বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, টানেল তো প্রথম বছর গাড়ি চলাচল কম থাকবে, এর পর ধারাবাহিকভাবে এক বছর পর পর বাড়বে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ ছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বছর অতিবাহিত হওয়ার পর  বোঝা যাবে আসলে এটি গলার কাঁটা কিনা। তবে মীরসরাই ইকোনমিক জোনে শিল্প কারখানার উৎপাদন পরিপূর্ণভাবে শুরু হলে এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কাজ শুরু হলে টানেলের সুফল পাওয়া যাবে প্রত্যাশা করি। তবে টানেলে ব্যয় বেশি হয়েছে এটি অস্বীকার কেউ করবে না। সাবেক সড়ক, সেতুমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের  কয়েকজনের কারণেই এ প্রকল্পে কয়েকবার মেয়াদ বৃদ্ধি করে টাকা লোপাট হয়েছে।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৯ অক্টোবর যান চলাচলের জন্য তা উন্মুক্ত করা হয়। সমীক্ষা অনুযায়ী এ টানেলে দৈনিক ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চলাচল করার প্রত্যাশা ছিল। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্রথম বছর গড়ে প্রতিদিন ৩ হাজার ৯১০টি গাড়ি চলেছে টানেলে। এ হিসেবে গড়ে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৪ টাকা  দৈনিক  টোল আদায় হলেও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ে গুনতে হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩ টাকা। অর্থাৎ ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশও টানেল থেকে আয় হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১০ জুন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চীনের  বেজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় কাজ। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার  দৈর্ঘ্যরে টানেলে প্রতিটি সুড়ঙ্গের  দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিমপ্রান্তে রয়েছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার  দৈর্ঘ্যরে একটি ওভারব্রিজ করা হয় দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারাপ্রান্তে। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও  মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় ২০২২ সাল পর্যন্ত। আর বাড়তে থাকে প্রকল্প ব্যয়। সব মিলিয়ে টানেল প্রকল্পে ব্যয় পৌঁছায় ১০ হাজার ৬৯০  কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনকে ঋণ বাবদ ৬ হাজার ৭৭ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখ্য, এ টানেলে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

×