ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১

অনিন্দ্য সুন্দর কারুকাজ

প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব কাঠের ঘর, যাবে ইউরোপে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব কাঠের ঘর, যাবে ইউরোপে

বাগেরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি, যাবে ইউরোপ

কেউ তৈরি করছেন বসতঘরের দরজা জানালা, কেউ ফ্রেম আবার কেউ তৈরি করছেন দেওয়াল। সবশেষে দক্ষ শ্রমিকদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় রং পালিশের শেষ হচ্ছে নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি। ঘরের ভেতর-বাইরে এমন অনিন্দ্য সুন্দর কারুকাজ, যা প্রথম দৃষ্টিতেই মুগ্ধ আকর্ষণ করে।  
এমন দৃশ্য দেখা যায় বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রত্যন্ত কররী গ্রামের একটি ফার্নিচারের কারখানায়। বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের সিঅ্যান্ডবি বাজার সংলগ্ন এ  গ্রামের ‘ন্যাচারাল ফাইবার’ নামের কারখানায় তৈরি ঘরগুলো রপ্তানি করা হবে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের ‘পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে’। 
আশপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা কাঠ দিয়ে বসতবাড়ি তৈরি  হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে। কাঠের তৈরি এই বাড়ির কাঠামো, দেওয়াল, দরজা-জানালা এমনকি ছাদও কাঠের তৈরি। প্রথমে কাঠ কেটে ও সাইজ করে পুরো বাড়িটি তৈরি করে শ্রমিকরা। বাড়িটি ১১ মিটার লম্বা এবং চওড়া সোয়া ৪ মিটার। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। এর পর বিভিন্ন অংশকে ছোট আকারে খ- খ- করা হয়। ফলে পুরো বাড়িটিকে স্বল্প স্থানে সহজে পরিবহন করা যায়। পরবর্তীতে এই খ-াংশগুলো জুড়ে যেকোন জায়গায় স্থাপন করা সম্ভব।
ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, পরিবেশের ক্ষতি করে না এমন পণ্য ব্যবহার করে ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম থেকে চলতি বছরের প্রথম দিকে ১২০টি বসতবাড়ি তৈরির অর্ডার পান বাগেরহাট বিসিক শিল্পনগরীর উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ। এরপর থেকে পরিবেশবান্ধব বসতবাড়ির তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। 
ব্যবসায়ী মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘বেলজিয়ামের একটি ইকো পার্কের জন্য বায়াররা অর্ডার দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব কাঠের তৈরি এ রকম ১২০টি বসতঘর তাদের প্রয়োজন, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে বেলজিয়ামে পাঠানো হবে।’ 
তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে, দেশি মেহগনি কাঠ দিয়ে এই ঘরগুলো তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া, এসব বাড়ির কাঁচামাল বায়োগ্রেডিবল বা পরিবেশে মিশে যায় এমন হতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো পণ্য ব্যবহার করা যাবে না। পরিবেশবান্ধব এই বাড়ি রপ্তানির মাধ্যমে নতুন বাজার সৃষ্টি, কর্মসংস্থান তৈরি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন পথ উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে এই উদ্যোগ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।’ 
প্রথমবারের মত নিজ দেশের এই পণ্য ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে শ্রমিকরাও খুশি। কাঠমিস্ত্রি মোজাহিদ বলেন, ‘আমাদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারপরে ডিজাইন দেখে সম্পূর্ণ একটি বসতঘর তৈরি করেছি। এর পর কোম্পানি ও বিদেশী লোকজন দেখে পছন্দ করছে। এখন আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করেছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতিটি বসতঘর তৈরি করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে। প্রায় ২’শ জন শ্রমিক এই বাড়ি তৈরির কাজ করছেন।’ 
কারখানার শ্রমিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগে কখনো এই ঘর তৈরি করিনি। এখন দেখছি খুবই সুন্দর হয়েছে ঘরগুলো। সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে এভাবে ঘর তৈরি করা যায় কখনো ভাবতেও পারিনি। দুটি বেডরুমে মোট পাঁচজন থাকার উপযোগী এ ঘর সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঘরের একপাশে একটি বারান্দা, বেডরুমের সঙ্গে বাথরুম ও বসার ঘর রয়েছে। বসার ঘরে টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা এবং ঘরের ভেতরেই রান্না করারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঘরের প্রতিটা অংশ খুলে প্যাকিং করে পাঠানো হবে বেলজিয়ামে।’
সাইফুল নামের অপর এক শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের হাতে তৈরি কাঠের ঘর বিদেশে যাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা এই ঘর তৈরি করতে পেরে খুবই আনন্দিত।’
কথায় কথায় জানা গেল, চলতি বছরের শুরুর দিকে গ্রীসের কোকোম্যাট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেলজিয়াম থেকে কাঠের ঘর তৈরির অর্ডার পায় বাগেরহাটের ন্যাচারাল ফাইবার নামক প্রতিষ্ঠানটি। এর পর থেকে কাঠের ঘরের স্যাম্পল তৈরি শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। কাঠের তৈরি স্যাম্পল ঘরটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পছন্দ হওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে ১২০টি ঘর তৈরি করে রপ্তানির জন্য কাজ শুরু করে ন্যাচারাল ফাইবার নামের এই প্রতিষ্ঠানটি।
পাইরি ডাইজা ইকো পার্কের প্রধান স্থপতি পেসেল ডি বেক বলেন, আমরা এখানে এসেছি কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি এখানের মানুষ কারুশিল্পে দক্ষ। এছাড়া এই এলাকার কাঠও খুবই উন্নত। আমরা এই কাঠের বাড়িগুলোয় থেকেছি, তবে সেখানে অবশ্যই মশার ভয় ছিলো। আমাদের দেশে এত মশা নেই। তবে আমরা বাড়িগুলোতে থেকে খুবই শান্তি পেয়েছি। কাঠের ঘর হওয়ায় এর মধ্যে থাকতে খুবই প্রশান্তি লেগেছে, মনে হয়েছে প্রকৃতির কাছেই আছি। বাংলাদেশী কাঠমিস্ত্রিদের দক্ষতা অনন্য। আমরা মনে করছি সামনে আরো প্রজেক্ট আমরা আনতে পারবো।’
কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার শংকর বিশ্বাস বলেন, আমরা এখানে যে ঘর তৈরি করছি তা বিশ্বমানের পরিবেশবান্ধব ঘর। ক্রেতাদের ডিরেকশন অনুযায়ী আমরা প্রথমে যে ঘরটি কমপ্লিট করেছি সেটি ক্রেতারা পছন্দ করেছেন। এর মাধ্যমে কাঠের তৈরি ঘর রপ্তানিতে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। আমাদের কাছ থেকে তারা মোট ১২০ টি ঘর ক্রয় করবেন। আমরা অত্যন্ত যতœ সহকারে কাজ করছি, যাতে ইউরোপের বাজারে আমাদের চাহিদা আরো বৃদ্ধি পায়।’ 
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ আরও বলেন, আমরা ক্রেতাদের নির্দেশনা ও ডিজাইন অনুযায়ী একটি আস্ত ঘর তৈরি করে প্রথমে দেখিয়েছি। ক্রেতারা আমাদের যে ডিজাইন ও ডিরেকশন দিয়েছেন, সে অনুযায়ী কাজ হয়েছে কিনা সেটি তারা যাচাই করে দেখেছেন। তারা এই ঘরে রাত্রি যাপন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। আগামী বছর জুন মাসের ভেতর মোট ১২০টি ঘর তৈরি করে তাদেরকে দিতে হবে। আমাদের লোকজন গিয়ে পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে ঘরগুলো সেট করে দিয়ে আসবে।

×