বান্দরবানের দূর্গম পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর খুমী সম্প্রদায় উঠে আসা ছাত্রী তংসই খুমী প্রথম বারের মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে। তিনি খুমী সম্প্রদায়ের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩-২৪ সেশনে ভর্তি হয়েছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তংসই খুমী ছোটবেলা থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ২০১৪ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বুনন শুরু করেন তিনি। তংসই খুমীর গ্রামের বাড়ি পার্বত্য বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের দুর্গম মংঞো পাড়ায়। বান্দরবান জেলাশহর থেকে তাদের বাড়িতে একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে সাঙ্গু নদীর নৌপথে যেতে হয়। এছাড়া তার বাবা নয়লো খুমীও খুমী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরিজীবী। তিনি রোয়াংছড়ি উপজেলা তারাছা ইউনিয়নে ঘেরাও মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
তবে তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১৪ সালে মারা যান। তংসই খুমী চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বাকী দুইভাইও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার বড়ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্স পর্বে এবং আরেক ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত আছেন। সর্বশেষে তার ছোট বোন ঢাকার সেন্ট যোসেফ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তংসই খুমী বান্দরবান শহরের কালেক্টরেট স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে বান্দরবান সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি ও হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত জুম একাডেমি কোচিং সেন্টারে বিনা খরচে কোচিং করেন। পরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩-২৪ সেশনে ভর্তি হয়েছেন। তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা ও ভাইদের অনুপ্রেরণায় পড়াশোনাতে এগিয়ে যাচ্ছেন তংসই খুমী। এছাড়াও তার বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহ রয়েছে এবং লেখাপড়া শেষ করে পিছিয়ে পড়া নারী ও নিজ সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করতে ইচ্ছুক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী তংসই খুমীর বড়ভাই সুইতং খুমী বলেন, তার বাবা মারা যাওয়ার পর চার ভাই-বোনকে লেখাপড়া খরচ চালান একমাত্র তার মা। ছোট বেলা থেকে সবার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর নিজেদের খুমী সম্প্রদায়ের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগতো সবার মধ্যে। কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করতে গেলে আগে নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সেই অনুপ্রেরণা থেকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন চার ভাই-বোন। এছাড়া, আমাদের চার ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিচ্ছে আমাদের মা।
তিনি বান্দরবান শহরে উজানী পাড়ায় থাকেন। ঘরে কোমর তাঁত বুনে খুমীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি করেন। সেটা বিক্রি করা আয়ের টাকা ও বাবার পেনশনের টাকায় লেখাপড়ার খরচ চালানো হয়। আমি নিজেও বাইরে গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর পার্টটাইম চাকরি করি। আমার এবং মায়ের আয়ের টাকা দিয়ে বাকী ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ চালাই বলে জানান তিনি।
খুমীদের সামাজিক সংগঠন খুমী সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি সিঅং খুমী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন খুমী ছাত্রী পড়লেও তংসই খুমী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। খুমীদের বেশির ভাগ মানুষ দুর্গম এলাকার বসবাস করেন। আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় কেউ চাইলেই এত সহজে উচ্চ শিক্ষায় আসতে পারে না। তংসই খুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হওয়া অন্যান্য শিক্ষার্থীর ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন যত দুর্গম এলাকার বাসিন্দা হোক উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। খুমী সম্প্রদায় থেকে এখন পর্যন্ত মোট এগারো জন শিক্ষার্থী দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নুগোষ্ঠীর এগারটি জাতি সত্ত্বার মধ্যে সবচেয়ে কম ভাষিক ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী হলেন খুমী সম্প্রদায়ের লোকজন। সরকারি হিসাবে গত ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ৩ হাজার ৯৯৪ জন। তাদের বসবাস একমাত্র বান্দরবান পার্বত্য জেলার জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি’সহ তিন উপজেলায়।
ছবির ক্যাপশান: ক্ষদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুমী সম্প্রদায়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেন পেয়েছেন তংসই খুমী।