ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

‘এটে যে রোগী নিয়ে আইসে তায়ে রোগী হয়া যায়’

আব্দুস সালাম, রংপুর

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

‘এটে যে রোগী নিয়ে আইসে  তায়ে রোগী হয়া যায়’

.

রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রাণকেন্দ্র রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এরই মধ্যে নতুন করে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্গন্ধ। পরিচ্ছন্নতাকর্মী না থাকায় চিকিৎসা বর্জ্যসহ ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে হাসপাতালটি। এসব থেকে ছড়িয়ে পড়ছে রোগজীবাণু। রোগীদের অভিযোগ, সুস্থ হতে এসে, তারা আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।

রমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এক হাজার শয্যার হাসপাতালটির ৪২টি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। ছাড়াও বহির্বিভাগে দুই হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে। প্রতিদিন ভর্তি রোগী বহির্বিভাগে আসা রোগীদের সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার স্বজনের উপস্থিতি থাকে। যার ফলে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে চিকিৎসা বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা সৃষ্টি হয়। এসব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য সরকারিভাবে মাত্র ৬৩ জন চুক্তিভিত্তিক ২০০ কর্মী নিয়োগ দেওয়া ছিল। চুক্তিভিত্তিক ২০০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী মেয়াদ শেষ হলে, তারা হাসপাতালে কাজ বন্ধ করে দেন। ফলে পুরো হাসপাতালজুড়ে ময়লা জমতে শুরু করে। গত ১৫ দিনে প্রায় ১০ টন ময়লা-আবর্জনা স্তূপ হয়ে হাসপাতালের ভেতরে বাইরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এসব ময়লার উৎকট গন্ধে রোগী স্বজনেরা নাক-মুখ চেপে চলাচল করছে।      

২৫ অক্টোবর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। দুর্গন্ধে রোগী স্বজনেরা নাক-মুখ চেপে চলাচল করছে। বারান্দা-মেঝেতে, শয্যার নিচের ময়লা থেকে মশা-মাছি ছড়িয়ে পড়ছে রোগী-স্বজনদের শরীর, খাবারে। শৌচাগারগুলোতে ময়লা মল-মূত্র-পানিতে ডুবে যাওয়ায় ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের বাইরে পুরো এলাকাজুড়ে বড় বড় ময়লার ভাগাড় দেখা গেছে। সেগুলোতে কুকুর, বিড়াল, গরু বিরচণ করায় প্রকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।

হাসপাতাল চত্বরে কথা হয় নীলফামারী কৈমারী গ্রামের কৃষক সাইফুল এর সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাই দেখেন চারদিকে কত ময়লা, কি পরিমাণ দুর্গন্ধ। অসুস্থ মাকে চিকিৎসক দেখাতে এসে দুর্গন্ধে বমি করে নিজেই অসুস্থ হয়ে গেছি। যে হাসপাতালে মানুষ সুস্থ হতে এসে অসুস্থ হয় সেটার দরকার কি? এগুলো কি কেউ দেখে না। অন্তত ১৫ জন রোগীর সঙ্গে কথা হলে তারা অভিযোগ করে বলেন, ১০-১২ দিন ধরে হাসপাতালে কোনো পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার কাজ হয় না। ডাস্টবিনগুলো ময়লায় ভরে গেছে। মেঝে বারান্দা শয্যার নিচে ময়লার স্তূপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় সেখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা হাসপাতালের পরিবেশ ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন।

হাসপাতালে ভর্তি মেঝেতে থাকা লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের গৃহিণী সালেহা খাতুন সামনে থাকা ময়লা দেখিয়ে বলেন, ‘দেখেন সামনে কী। খুবই ময়লা। পস্রাবখানা, পায়খানা (টয়লেট) যাওয়া যায় না। এটে যে রোগী নিয়ে আইসে, তায়ে রোগী হয়া যায়। এটে মানুষ থাকে কেমন করি কন তোরায়।

মেডিসিন বিভাগের সামনে আক্ষেপ করে বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ির গ্রামের রোগীর স্বজন আনছার আলী বলেন, ‘এমনি বেড নাই, তার ওপর দুর্গন্ধ। ১০-১৫ মিনিট পর পর কেউ না কেউ বমি করে। এখানে খাবার পরিবেশ নাই। সবচেয়ে জঘন্য নোংরা হচ্ছে বাথরুমগুলো। মাকে নিয়ে এসে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে গেছি। অন্য কোথাও চিকিৎসা করার সামর্থ্য নাই যেজন্য এখানে আছি।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি এক হাজার শয্যার হাসপাতালে সাড়ে চার হাজার রোগী সেবা নেয়। প্রতিদিন রোগী-স্বজন মিলে প্রায় ১০ হাজার মানুষের যাতায়াত, সেই তুলনায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী নেই। মাত্র ৬৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে পুরো হাসপাতাল পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাদের কাজ করতে বলতে আমরা পারি না। সেজন্য ময়লা জমা হয়েছে। শুধু ময়লাই নয়, হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সের সংকট তো আছে। সব মিলে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। একদিনে এসব সমাধান করা সম্ভব নয়।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফায়সাল বলেন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার কাজ অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছি। মেডিক্যাল প্রশাসনকে অনুরোধ করব তাদের পরিচ্ছন্নতা কর্মী দিয়ে হাসপাতাল সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে আসা সকলকে সচেতন হতে হবে। আশা করছি খুব শীঘ্রই একটা পরিষ্কার মেডিক্যাল হবে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল পরিচালক ডা. জাফরুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ময়লা নিয়ে আসলেই সমস্যা। আমি নতুন এসেছি, চেষ্টা করছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে। তবে রোগী স্বজনদেরকে সচেতন হতে হবে। তারা সচেতন না হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।

×