ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

ভাঙল সাধুর হাট

ছেঁউড়িয়ার বারামখানা ছেড়ে নিজ আশ্রমে ফিরছেন সাঁইজি ভক্তরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুষ্টিয়া

প্রকাশিত: ০০:৫০, ২০ অক্টোবর ২০২৪

ছেঁউড়িয়ার বারামখানা ছেড়ে নিজ আশ্রমে ফিরছেন সাঁইজি ভক্তরা

কুষ্টিয়ায় লালন ধামে আপন মনে একতারায় গান ধরেছেন এক বাউলানী

অষ্ট প্রহরের সাধু সংঘের মধ্যদিয়ে শুক্রবার ভেঙেছে সাধুরহাট। এদিন বিকেল থেকেই গুরু, শিষ্য, লালনভক্ত, সেবাদাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাঁইজির পুণ্যভূমি ছেঁউড়িয়ার বারামখানা ছাড়তে শুরু করেন সাধুরা। বাউল স¤্রাট ফকির লালন শাহ’র ১৩৪তম তিরোধান বা মৃত্যু দিবস উপলক্ষে লাখো মানুষের ¯্রােত মিশেছিল কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে।

রাত যতই গভীর হয়েছে সাঁইজির টানে মানুষের চাপ ততই বেড়েছে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা এসেছেন রিক্সায় চেপে; কেউ বাস কিংবা অন্য যানবাহনে। সবারই গন্তব্য ছিল লালনধাম, ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি। যেখানে মিলন ঘটে নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের। সাধুর হাটে বাউল-সাধুরা গুরু ভক্তি ও ভাবগাম্ভীর্যে পালন করেন নানা আচার অনুষ্ঠান। সবার মন মজে লালনের আধ্যাত্মিক গানে। 
লালনের গান পরিবেশন করে অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখেন তারকা শিল্পী বিউটি ও কাঙ্গালিনী সুফিয়াসহ অন্যরা। রাতভর বাউল শিল্পীরা তাদের মতো করে পরিবেশন করেন লালনের গান। তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়া লালন একাডেমির আয়োজনে রাতের খাবার ‘অধিবাস সেবা’ (রাত ১২টার পর), সকালের নাস্তা ‘বাল্যসেবা’,  দুপুরের খাবার ‘পুণ্যসেবা’ ও সন্ধ্যারাতের খাবার ‘রাখালসেবা’ গ্রহণ করেন প্রায় সাত হাজার বাউল-সাধু। 
শেষদিন ছিল শনিবার। অষ্ট প্রহরের সাধুসংঘের (পুন্যসেবা) মধ্যদিয়ে শুক্রবার ভাঙে সাধুরহাট। বিকেল থেকে আখড়াবাড়ি ছাড়তে শুরু করেন সাধুরা। অনেকেই আবার লালন ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে পোটলা-পুটলি গুটিয়ে আখড়াবাড়ি ছেড়ে রওনা হবেন নিজ আশ্রমের দিকে। বাউলরা যেভাবে আসেন ঠিক সেভাবেই ফিরে যান। আখড়াবাড়িতে আসতে সাধুদের যেমন কোনো চিঠি লাগে না তেমনি ফিরে যেতেও কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন পড়ে না। সাধুদের মতে, লালন ভক্তরা সঁাঁইজির পণ্যধামে ছুটে আসেন মনের টানে। আখড়বাড়িতে উপস্থিত হয়ে পালন করেন আচার অনুষ্ঠান। দু’দিনের কর্মযজ্ঞ শেষ হওয়ার পর তারা চলে যান নিজ নিজ আশ্রমে। 
বাউল-সাধুরা লৌকিকতা পছন্দ করেন না। তারা সাঁইজিকে ভক্তি, শ্রদ্ধা জানাতে এবং নিজের মধ্যে ভাববিনিময় ও গুরুকে খুঁজতেই ব্যস্ত থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন, আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া সম্ভব। তারা এখানে আসেন সাঁইজির সাক্ষাৎ পেতে। সেই সঙ্গে দেখা হয় তার পূণ্যভূমি। 
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ লালনের এই অমর বাণীকে স্মরণ করে এবার তার ১৩৪তম মৃত্যু দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী লালন মেলা। লালনের জীবন দর্শন ও স্মৃতিচারণ করে আলোচনা সভা ও লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। 
লালন মাজারের খাদেম আহম্মদ আলী বলেন, ‘সত্য ও সুপথের সন্ধানে মানবতার দীক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধু-গুরু ও ভক্তরা দলে দলে এসে সাঁইজির মাজারে আসন গাড়েন। তারা গেয়ে চলেন সাঁইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও দেহতত্ত্বের গান।’ লালনের গান কেবল পল্লীবাংলার হাজার হাজার মানুষকেই মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেনি, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও অনুপ্রাণিত করেছে। 
শনিবার অনুষ্ঠানের শেষদিন রাতে প্রধান অতিথি ছিলেন, খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোসা. শারমিন আখতারের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, খুলনা রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি মো. রেজাউল হক, কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান প্রমুখ।

×