ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

ছানার রসগোল্লা

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

ছানার রসগোল্লা

ছানার রসগোল্লা

ভোলার মজাদার খাবারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ছানার রসগোল্লা। ভোলার ছানার রসগোল্লার খ্যাতি এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছেও জনপ্রিয়। শুধু রসগোল্লাই নয় এর সঙ্গে রয়েছে রসমঞ্জুরী, স্বরমালাই, গুড়ের ছানার রসগোল্লা, ছানার সন্দেশসহ নানা মজাদার খাবার। তাই দেশব্যাপী রয়েছে এর প্রচুর চাহিদা।
ভোলায় যে কোনো অনুষ্ঠান বিয়ে, বৌ-ভাত, জন্মদিন এমনকি কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেলেও এ রসগোল্লা হাতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে ভোলার বিখ্যাত এ ছানার রসগোল্লার স্বাদ যারা একবার পেয়েছে তারা বারবার ছুটে আসে এ মিষ্টির স্বাদ নিতে। ভোলার এ সুস্বাদু মিষ্টি ঢাকায় প্রিয়জনের জন্যও কেউ কেউ নিয়ে যায়। এ মিষ্টি এখন ভোলার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন এখানকার মিষ্টির দোকানগুলোতে সকাল-সন্ধ্যা ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। কেউ কেউ বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসে দোকানে বসে খাচ্ছে আবার কেউ কেউ প্যাকেটে করে নিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু ছানার রসগোল্লা। 
জানা যায়, প্রাচীন সময় থেকে দ্বীপ জেলা ভোলার অসংখ্য ছোট বড় অনেক চরে গরু-মহিষ পালন হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে ছোট-বড় পারিবারিক ও ব্যবসায়িক গরুর খামার। চর ও খামারগুলো থেকে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে মহিষ ও গরুর খাঁটি দুধ। আর সেই দুধ থেকে ভোলায় তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু ছানার রসগোল্লা ও মহিষের দুধের টক দইও। মহিষের দুধের টক দই ও ছানার রসগোল্লা কেন্দ্রিক  তৈরি হয়েছে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এগুলোর পাশাপাশি তৈরি করা হয় রসমঞ্জুরী, স্বরমালাই, গুড়ের ছানার রসগোল্লা, ছানার সন্দেশসহ শুকনো নানা ধরনের মিষ্টি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শত শত লোক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এত এত মিষ্টির মাঝে ভোলার ছানার রসগোল্লার খ্যাতি ভোলায় তো রয়েছেই পাশাপাশি ভোলার আশেপাশের জেলাগুলোতেও রয়েছে এ মিষ্টির বেশ সুনাম।
মিষ্টি ক্রেতারা জানান, এমন স্বাদের খাঁটি ছানার রসগোল্লা একমাত্র ভোলায়ই পাওয়া যায়। এবং এটি ভোলার একটি ঐতিহ্য বহন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি এ ছানার মিষ্টির এমনি স্বাদ কেউ একবার না খেলে বুঝতে পারবে না। অন্যান্য জেলায়ও এমন মিষ্টি পাওয়া যায় তবে ভোলার রসগোল্লার মতো স্বাদ পাওয়া যায় না। এখানকার এ মিষ্টি পিওর ছানা দিয়ে তৈরি হওয়ায় অন্য জেলার মিষ্টির চেয়ে এটি স্বাদের দিক থেকে আলাদা। 
ভোলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মিষ্টির দোকান।
বিশেষ করে ভোলা সদরে ঘোষপট্টিতে একসঙ্গে দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে অনেক মিষ্টির দোকান। এই এলাকাটি মিষ্টি ও দধি বিক্রেতাদের একটি বাজারে পরিণত হয়েছে অনেক আগ থেকেই । ঘোষপট্টিতে এমনি একটি মিষ্টির দোকানের নাম মুসলিম সুইটস। এ দোকানের তৈরি মিষ্টির বেশ সুনাম রয়েছে ভোলায়। এ দোকানটিতে ১৫-২০ জন শ্রমিক মিষ্টি তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এদের মধ্যে মো. কবির বহু বছর যাবৎ মিষ্টি তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। কথা হয় তার সঙ্গে সুস্বাদু এ মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে।
এ সময় মো. কবির জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন চরাঞ্চল ও খামার থেকে গোয়ালরা দোকানে দুধ নিয়ে আসে। তারপর সে দুধ নির্দিষ্ট পাত্রে ঢেলে রাখা হয় কিছু সময়। পরে মিষ্টি তৈরির কারিগররা সে পাত্র থেকে দুধ তুলে নিয়ে জ্বলন্ত চুলায় থাকা বড় বড় কড়াইয়ে ঢেলে কিছু সময় নাড়তে থাকেন। 
পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে দুধ দিয়ে ছানা তৈরি করেন। তারপর ছানাগুলোকে পরিষ্কার কাপড়ে তুলে নিয়ে ঝুলিয়ে পানি ঝরিয়ে অন্য একটি পাত্রে রাখা হয়। তারপর ছানাগুলোকে কারিগররা তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়াতে  মিষ্টি তৈরির পর্যায়ে নিয়ে আসে। পরে ১০ টাকা ও ২০ টাকা মূল্যের ভিন্ন ভিন্ন আকার অনুযায়ী দুই হাতের তালু দিয়ে পাকিয়ে গোলাকার আকৃতি দেন। অন্য কারিগররা জ্বলন্ত চুলার বড় বড় কড়াইয়ে টগবগ টগবগ করে জ্বাল দিতে থাকেন চিনির সিরা। সিরা হয়ে এলেই গোলাকার ছানাগুলো সেই সিরায় ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর সেগুলোকে নির্দিষ্ট সময় ধরে সিদ্ধ করা হয়। যখন সিদ্ধ হয়ে আসে তখন সে মিষ্টিগুলোকে পাতলা সিরা থাকে এমন একটি বড় পাত্রে রাখা হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় ভোলার সুস্বাদু ছানার রসগোল্লা। 
মুসলিম সুইটসের পরিচালক খোকন বলেন, তার বাবা ও চাচা এ দোকানটি ২০০০ সাল থেকে পরিচালনা করে আসছিলেন। এখন তার বাবা ও চাচা দুজনই মারা যাওয়ায় নিজেই প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেছেন। তার দোকানে প্রতিদিন ১৪-১৫ মণ গরুর দুধ আসে। এসব দুধ দিয়ে সুস্বাদু রসগোল্লা ও অন্যান্য মিষ্টির জন্য ছানা তৈরি করা হয়। ১ মণ দুধে ৬ কেজি বা সাড়ে ৬ কেজি ছানা তৈরি হয়। ১ মণ দুধের ছানা দিয়ে ১০ টাকা মূল্যের ৩০০-৩৫০ পিস মিষ্টি হয়। আবার ওই একই পরিমাণ দুধের ছানা দিয়ে ২০ টাকা মূল্যের মিষ্টি বানানো হয়। এতে ১৭০-১৭৫টি মিষ্টি বানানো যায়। 
তিনি আরও বলেন, তার দোকানে বিভিন্ন মূল্যের প্রতিদিন ৬-৭ মণ মিষ্টি বেচাকেনা হয়। এ মিষ্টি বিক্রি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো আছেন তিনি। তার দোকানে কারিগর ও শ্রমিক সব মিলিয়ে ১৫ জন কাজ করেন। সবাই এ মিষ্টির দোকানে কাজ করে পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছেন বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি এ মিষ্টির স্বাদ নিতে অন্যান্য জেলার মানুষদের ভোলায় তার মিষ্টির দোকানে আসার জন্য আহ্বান জানান। 
অন্যদিকে এ দোকানে কাজ করা কর্মচারীরা জানান, দীর্ঘদিন মিষ্টির দোকানে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। কর্মদক্ষতার দিক থেকে তারা অনেক পারদর্শী। এ দোকানের মতো অনেক দোকান ভোলায় রয়েছে। শত শত শ্রমিক মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। সব মিলিয়ে এখানে কাজ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই খুব ভালো আছেন বলেও জানান তারা।
ভোলার সুস্বাদু এ রসগোল্লা বিষয়ে জেলা স্বার্থরক্ষা কমিটির সম্পাদক অমিতাভ অপু বলেন, ভোলার মিষ্টির সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে। খাঁটি ছানা দিয়ে এখানকার মিষ্টিগুলো তৈরি হচ্ছে। দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও ভোলার এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি গিয়েছে। এ মিষ্টির এমনই স্বাদ ভোলায় ঘুরতে আসা অনেকেই এ মিষ্টি একবার খেয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এ মিষ্টির যে উৎপাদন এটি ধরে রাখা প্রয়োজন। এটি যেন নতুনভাবে অর্থ বিনিয়োগ করে সম্প্রসারিত করা হয়।

শুধু ভোলার চাহিদা নয় দেশের চাহিদাও পূরণ করতে পারে এ সুস্বাদু মিষ্টি। উদ্যোক্তারা যদি মিষ্টি ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে আরও এর প্রসার ঘটবে বলে মনে করেন তিনি। খাঁটি ছানার এ রসগোল্লা ভোলার একটি ঐতিহ্য বহন করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও বেশ ভূমিকা রেখে আসছে। দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ুক এ মিষ্টির স্বাদ এমনটাই প্রত্যাশা ভোলার সাধারণ মানুষের। 
হাসিব রহমনা, ভোলা

×