ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

পাঁচশ’ বছরের শাহী মসজিদ

প্রকাশিত: ০১:৩২, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

পাঁচশ’ বছরের শাহী মসজিদ

বেতাগী উপজেলার পাঁচশ’ বছরের পুরনো বিবিচিনি শাহী মসজিদ

মোগল আমলের অন্যতম পুরাকীর্তি বরিশাল জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বাকেরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে  বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি শাহী মসজিদ। পাঁচশ’ বছরের পুরনো এ মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করছে পর্যটকদের। দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। 
বাকেরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে বরগুনা আঞ্চলিক সড়কে ২৫ কিলোমিটা দক্ষিণে ও বেতাগী উপজেলা শহর থেকে আঞ্চলিক সড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার গেলেই বিবিচিনি গ্রাম। সেখানেই চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে উঁচু এক টিলার ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। মসজিদের সামনের দিকে বড় বড় খেজুরগাছসহ নানা প্রজাতির গাছের বাগান। 
কথিত আছে এই মসজিদকে ঘিরে উপকূলীয় বাংলায় ইসলাম প্রচার শুরু হয়। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই স্থাপনা আকারে বড় না হলেও স্থাপত্য শৈলীতে বেশ রাজসিক হওয়ায় মসজিদটি দেখে মুগ্ধ হন সবাই। তাই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে ছুটে আসেন পর্যটকরা। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে মুসল্লিদের আগমনে মসজিদ প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক গল্পও।
ইতিহাস ও স্থানীয়দের মুখে এমন গল্প থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের আমলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নামের এক সাধক পারস্য থেকে দিল্লি আসেন। ওই সময় শাহজাহানের দ্বিতীয় ছেলে বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ইসলাম প্রচারে শাহ নেয়ামতুল্লাহ তার শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে নোঙর করেন। তখন শাহ সুজার অনুরোধে গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ করা হয়।

পরে নেয়ামতুল্লাহর কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের নাম রাখা হয় বিবিচিনি এবং মসজিদটির নামও সেখান থেকেই নেওয়া। এ ছাড়াও শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নে বিবিচিনি গ্রামের পাশের গ্রামের নাম রাখা হয় নেয়ামতি।
আরও জানা যায়, বিষখালী নদীর পানি লবণাক্ত থাকায় সুপেয় পানির অভাবে এই এলাকার মানুষেরা অনেক কষ্টে ছিল। শাহ নেয়ামতুল্লাহ কষ্ট অনুভব করেন এবং তার তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দেন। অলৌকিকভাবে এতে এখানকার পানি সুপেয় হয়ে যায়। আজও সেই পানি তেমনই রয়েছে।
এছাড়াও ওই সময় সুন্দরবন সংলগ্ন বিষখালীতে কুমিরের ভয়ংকর আনাগোনা ছিল। কিন্তু শাহ নেয়ামতুল্লাহ আসার পর থেকে নাকি বিবিচিনির ধারে কাছেও কোনো কুমির আসত না।
মুঘল আমলের মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে ৩টি করে মোট ছয়টি জানালা আছে। জাফরি ইট দিয়ে তৈরি মসজিদটি সমতল থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচু টিলার উপর। মসজিদের মধ্যে প্রবেশের জন্য একটি দরজা। মসজিদটির টিলার ওপর উঠতে দর্শনার্থী ও মুসল্লিদের জন্য পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। পূর্ব পাশের সিঁড়িটি ২৫ ধাপের, উচ্চতা ৪৬ ফুট এবং দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটি ২১ ধাপের, উচ্চতা ৪৮ ফুট। তবে দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটির অধিকাংশ স্থানই ভেঙে গেছে। 
মসজিদের কাছেই ৩টি পুরনো দীঘি ছিল। এসব দীঘি নিয়েও বেশ জনশ্রুতি আছে। বড় দীঘিটির নাম ইছাবিবির দীঘি। বর্তমানে দীঘিগুলোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও মসজিদের পাশে ৩টি কবর আছে। লম্বায় একেকটি ১৪ থেকে ১৫ হাত। মসজিদটির পশ্চিম ও উত্তর পাশের কবরে শায়িত সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং চিনিবিবি ও ইছাবিবি।
এদিকে ঐতিহ্যের সাক্ষী এই স্থাপনার কিছু কিছু অংশের দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেলে ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে তা মেরামত করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
জিয়াউল হক, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল

×