ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

ফানুস ওড়ানো উৎসব

রাতের আকাশ আলোকিত করে তারার মতো ভেসে বেড়ায়

মেজবাহউদ্দিন মাননু

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

রাতের আকাশ আলোকিত করে তারার মতো ভেসে বেড়ায়

কলাপাড়ায় প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ফানুস ওড়ানোর আনন্দে মেতেছে রাখাইনরা

রাখাইনদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। এই তিথিতে বরাবরের মতো এ বছরও বৃহস্পতিবার দিনভর বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করেছে কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠী। অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সন্ধ্যার পরে আকাশে ফানুস ওড়ানোর উৎসব। প্রত্যেক বছর কার্তিকের পূর্ণিমার এ তিথিতে রাতে দক্ষিণ উপকূলের পটুয়াখালীর সাগরপারের কলাপাড়ায় আকাশে ভেসে বেড়ায় ফানুসের আলো। যেন তারার মেলা। আর আনন্দে মাতোয়ারা থাকে রাখাইন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর থেকে সবাই। অতিথিসহ সজনদের জন্য থাকে বিভিন্ন ধরনের পিঠে-পুলির আয়োজন।

বিন্নি চালের গুঁড়ায় বানানো ওই পিঠে খেতে আলাদা স্বাদ, না খেলে বোঝানোর নয়। এ উৎসবে শামিল হয় ভিন্ন ধর্মের মানুষও। যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্মিলন ঘটে। তবে আগের সেই জৌলুস নেই। এখানকার অন্তত আড়াইশ’ বছরের এ উৎসবের কলেবর এখন অনেক ছোট ও ম্লান হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের আর্থিক জোগানে হাত বাড়াতে হয় সরকারের কাছে। এক সময়ের দাপুটে আদিবাসী এ রাখাইন জনগোষ্ঠী তারপরও উৎসবের এ ছন্দ ধরে রেখেছেন। সরকারিভাবে এ বছরও কলাপাড়ার ২৪টি রাখাইন পল্লীতে অনুষ্ঠানের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
সাগরপারের কলাপাড়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা আড়াইশ’ বছর ধরে পালন করে আসছে ফানুস উৎসব। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই উৎসব চলে। দিনভর ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় আকাশে ফানুস ওড়ানোর উৎসব। কিন্তু আগের মতো এখন আর সেই জৌলুস নেই এ উৎসবে। এক সময়ের দাপুটে এ জনগোষ্ঠী বহুবিধ সমস্যা জমি-জমা দখলের কারণে এখন পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে। তারপরও সাধ্যমতো উৎসবের মধ্য দিয়ে চলে ফানুস উৎসব।

১৯৬০ সালের শেষের দিকেও প্রত্যেকটি রাখাইন পাড়া থেকে প্রবারণা পূর্ণিমার সময় টানা তিন দিনের এই ফানুস উৎসবে প্রতি সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ১৫০/২০০টি ফানুস ওড়ানো হতো। আকাশ আলোকিত করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফানুস তারার মেলার মতো ভেসে বেড়াত। শুধু রাখাইন উপজাতি নয়, এই উৎসবে সমাবেশ ঘটে অন্য ধর্মের হাজারো মানুষের। একসময় (’৬০ সালের দিকে) বৃহত্তর পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাখাইন পাড়া ছিল ১৬৮টি। আর রাখাইন পরিবার ছিল পাঁচ হাজার ১৯০টি। আর বর্তমানে বরগুনা ও পটুয়াখালীতে মোট রাখাইন পাড়া রয়েছে মাত্র ৪৫টি।

যার মধ্যে কলাপাড়ায় ২৯টি, লোকসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। তার পরও ব্যাপক উৎসবের মধ্যে এ বছর রাখাইন বাসিন্দারা গভীর রাত অবধি ফানুস উৎসব করেছেন। তবে আগে টানা তিন রাত চলত ফানুস উৎসব। এবারে অধিকাংশ রাখাইন পল্লীতে এ উৎসব হয়েছে একদিনের।
কুয়াকাটা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহারের উপাধ্যক্ষ ইন্দ্রো বংশ ভিক্ষু জানান, আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণে এ উৎসব পালন করা হয়। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে পঞ্চশীল, অষ্টশীল এবং বুদ্ধপূজা হয়েছে। এ ছাড়া মন্দিরে বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে আলোচনা হয়। আর সন্ধ্যার পরে ফানুস ওড়ানো হয়। তিনি আরও বলেন, ‘প্রবারণা উৎসবকে ঘিরে আমরা ২৮ বুদ্ধের আসন পরিষ্কার ও নতুন সাজে রূপ দিয়েছি।

বৃহস্পতিবার কঠিন চীবর দান ও সন্ধ্যায় শতাধিক ফানুস উড়িয়ে ধর্মীয় আচারের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এবারের প্রবারণা উৎসব।’ গোড়া আমখোলা পাড়ার এক রাখাইন যুবক জানান, এ বছর তারা প্রায় ২০টি ফানুস আকাশে উড়িয়েছেন। অন্তত ৯ হাজার টাকা তাদের খরচ হয়েছে এসব করতে। মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ ভিক্ষু উত্তম ভান্তে জানান, তারা এ বছর রাতে প্রায় ৩০টি ফানুস আকাশে ছেড়েছেন। এজন্য তাদের প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

রাখাইনরা জানান, সাধারণত চার/পাঁচ ধরনের ফানুস তৈরি করেন রাখাইনরা। যার মধ্যে রয়েছে মালা ফানুস, প্যারাসুট ফানুস, বেনসান ফানুস, লেজ ফানুস, ¤্রাকেচা ফানুস উল্লেখযোগ্য। কলাপাড়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহার এলাকার বাসিন্দা রাখাইন সমাজকল্যাণ সমিতির নেতা টেনস্যুয়ে জানান, ফানুস তৈরি করতে চাইনিজ রঙিন কাগজ, বাঁশ, সুতি কাপড়, ছাতার জাঙ্গা, কেরোসিন, মটিয়া তেল, সুতা, মোম, গুনা এসব প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে এসব জিনিসপত্র সঠিক মানের পাওয়া যায় না।

কাগজ অনেক মোটা যা আকাশে বেশি সময় ওড়ে না। নিচে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে। যে কারণে ঝুঁকি থেকে যায়। তারপরও কলাপাড়ার অধিকাংশ রাখাইন পাড়ায় কম হলেও ২০/৩০টি করে ফানুস প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসবে আকাশে ওড়ানো হয়। শত দৈন্য থাকলেও প্রাবরণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ফানুস উৎসবকে কেন্দ্র করে রাখাইন পল্লীতে বিরাজ করে উৎসব মুখর পরিবেশ। নারী-পুরুষ সবাই মিলিত হন এ উৎসবে। নতুন সাজে, নতুন পোষাকে। হয় ধর্মীয় নানান নিয়মনীতির পালন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, এ বছর প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে কলাপাড়ার ২৪টি রাখাইন বৌদ্ধবিহারে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয়েছে।

×