ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

জলোচ্ছ্বাস আতঙ্কে রাত কাটে বিনিদ্র

৩০ হাজার মানুষের ঝুঁকিপুর্ণ বসবাস 

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া,পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ১৮ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১১:৪০, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

৩০ হাজার মানুষের ঝুঁকিপুর্ণ বসবাস 

অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি।

আনুমানিক এক যুগ আগে ৩৩ শতক জমি কিনেছেন কৃষি শ্রমজীবী মিজানুর রহমান। এখন চায়ের সঙ্গে মুদি দোকানি। তবে ছোট্ট পরিসরে। ওই দোকানের আয় দিয়ে চলে স্ত্রী শাহনাজ, ছেলে সাজিদ ও মেয়ে সানজিদাকে নিয়ে চলছে ছয় জনের সংসার। 

পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যেতে লোন্দা সেতু পেরিয়ে ওপার গেলেই ডান দিকে বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস মিজানুরের। অস্বাভাবিক জোয়ারের সময় থাকেন পানিবন্দী। বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পুর্ণিমায় ঘরের মধ্যে পানি ঢোকে। এভাবে ঝুঁকিপুর্ণ বসবাস মিজানুরের। 

দশ বছরের চরম দূর্ভোগের পরে ঘরের ভিটি অনেক উচু করেছেন। শুধু মিজানুর নন, সেতুর ডান দিকটায় মিজানুরের ভাইসহ আরও ৭/৮টি পরিবারের বসবাস। বাম দিকেও অসংখ্য বসতি। বর্ষা মৌসুমে জোয়ারে থাকেন পানিবন্দী। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা এঁরা। টিয়াখালী নদী তীরের জেগে ওঠা চরে বসতি তাঁদের।

ধানখালীর সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজউদ্দিন তালুকদার জানান, শুধুমাত্র লোন্দা থেকে নমরহাট বাজার পর্যন্ত এভাবে বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুঁকিপুর্ণ বসবাস করছে প্রায় এক হাজার পরিবার। পুরো ইউনিয়নে রয়েছে আরও অন্তত পাঁচ শ’ পরিবার। তিনি জানালেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসে এসব পরিবারে প্রাণহানির ঝুঁকি থাকছেই। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে মানুষগুলো বসবাস করছেন। কখনও এরা দূর্যোগকালীন সময় বাড়ি ছেড়ে সংলগ্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়। 

কখনও বিপদে পড়ছে। এসব মানুষের বসতি দিন দিন বাড়ছে। কারণ বেড়িবাঁধের স্লোপে থাকত এসব পরিবার। এখন বাঁধের উন্নয়নহ ওইসব এলাকা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। রাস্তাগুলো সম্প্রসারন করা হয়েছে। বাঁধের স্লোপ থেকে এরা উচ্ছেদ হয়ে গেছে। চম্পাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম বাবুল জানান, তার ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাইরে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে অন্তত ৬০টি পরিবার। এর মধ্যে দেবপুরে আটটি। গোলবুনিয়ায় সাতটি, পাটুয়ায় ১৫-২০টি পরিবার অস্বাভাবিক জোয়ারে পানিবন্দী হয়ে থাকে। চরম ঝুকিপুর্ণ বসবাস তাঁদের।

চেয়ারম্যান এবিএম হুমায়ুন কবির জানান, তার ইউনিয়ন বালিয়াতলীর চরনজীব থেকে বাবলাতলা বাজার পর্যন্ত প্রায় দুই শ’ পরিবার ছাড়াও পক্ষিয়াপাড়া বাজার থেকে শনিবারের বাজার পর্যন্ত আরও সাত আটটি পরিবার বাঁধের বাইরে ঝুকিপুর্ণ বসবাস করছে। ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ দেলওয়ার হোসেন জানান, ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুর্ব ডালবুগঞ্জ ৪১ ঘর। গাববাড়িয়া বাঁধ থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত ৪৫টি। ডালবুগঞ্জ, থানখোলা স্লুইস, রসুলপুর, পেয়ারপুর, ফুলবুনিয়ায় ৪০টি এবং মনষাতলী, খাপড়াভাঙ্গা ও বরকুতিয়ায় আরও ৩০টি পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুকিপুর্ণ বসবাস করছে। 

মিঠাগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী হেমায়েত উদ্দিন জানান, ইউনিয়নের তেগাছিয়া বাজারের আশপাশে ২৫টি। মিঠাগঞ্জে তিনটি, মেলাপাড়া ৪০টি, উত্তর চরপাড়া ৬৮, দক্ষিণ চরপাড়া প্রায় ১০টি এবং মধুখালীর লেকের দুই পাড়ে অন্তত ৬০টি পরিবার ঝুকিপুর্ণ বসবাস করছে। লতাচাপলীর সাবেক চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা জানান, এই ইউনিয়নের ১৮৭০টি পরিবার অস্বাভাবিক জেয়ারের সময় পানিবন্দী থাকে। এসব পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুকিপুর্ণ বসবাস করছে। মম্বিপাড়া, দক্ষিন মুসুল্লিয়াবাদ, নাইয়রিপাড়া, গোড়া আমখোলা পাড়া, লক্ষীর বাজার এলাকায় এসব পরিবারের বসবাস।

ধুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রহিম জানান, এখানকার গঙ্গামতি, চরগঙ্গামতি ও কাউয়ারচরে অন্তত তিন হাজার পরিবার খুব ঝুকিপুর্ণ বসবাস করছে। এদের বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক জোয়ারে বাড়িঘর পর্যন্ত ছাড়তে হয়। সিডরে এখানে প্রাণহানি ঘটে চার জনের। লালুয়ার চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস জানালেন বেড়িবাঁধের বাইরের ঝুঁকিপুর্ণ সহস্রাধিক পরিবার বসবাস করছে। এক যুগ ধরে বেড়িবাঁধ না থাকায় এসব পরিবারে এখন জীবিকার দূর্ভোগ পরিণত হয়েছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে। নীলগঞ্জের চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া জানান, নীলগঞ্জের আবাসনে বসবাসরত পরিবারগুলোসহ বাঁধের বাইরের শত শত পরিবারের বসবাস ঝুকিতে। অন্তহীন ভোগন্তি তাদের। 

একই দৃশ্য ১২টি ইউনিয়নের সর্বত্র। এভাবে অন্তত সাত হাজার পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে চরম ঝুঁকিপুর্ণ বসবাস করছে। এসব পরিবারের কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ জীবন, সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। এদের অমাবশ্যা ও পুর্ণিমার সময় বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কাটে বিনিদ্র রাত। জলোচ্ছ্বাস আতঙ্কে রয়েছে এসব হাজার হাজার পরিবারের মানুষ। লোন্দার ২৫০ পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য একটি রিং বেড়িবাঁধ মেরামতের দাবিতে ভূক্তভোগী মানুষ মানববন্ধন প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে আসছেন। কিন্তু দুর্গতি কমছে না। 

সবশেষ পূর্ণিমার প্রভাবে বুধ ও বৃহস্পতিবারের অস্বাভাবিক জোয়ারে ভাসতে দেখা যায় এসব পরিবারের বাড়িঘর। জোয়ারের সময় থাকছেন পানিবন্দী দশায়। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে জমিসহ সেমিপাকা ঘর দিয়ে প্রায় ৯০০ পরিবারকে নিরাপদ আবাসন দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপুর্ণ পরিবেশে বসবাস করা মানুষকে আবাসনের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

 এসআর

×